top of page

মনোজের সংসারে দুর্গা ঠাকুরের আশীর্বাদ । আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস



এক


বাড়ি থেকে বেরোলেই পুলিশ তাকে ধরে আচ্ছা করে পেটাচ্ছে। ভয়ে বাড়ি থেকে কেউ বেরোতে পারছে না। ফলে গরিব মানুষগুলোর হয়েছে যত বিপদ। বিশেষ করে যারা দিন আনে দিন খায়। শরীর যাদের সম্পদ। অর্থাৎ না খাটলে যারা খেতে পায়না। মনোজ হল সেরকমই একজন। গ্রামে বহু গরিব মানুষ আছে কিন্তু তার মতো গরিব কেউ নেই। কেননা, তাদের অন্তত নিজস্ব ভিটামাটিটুকু আছে। হয়তো দশ বিঘা জমি নেই, ব‍্যাঙ্কে হয়তো দশ লাখ টাকা নেই, কিন্তু মাথার উপর প্রত‍্যেকের ছাদ আছে। মনোজের যে সেটুকুও নেই। গ্রামের বাইরে মাঠের ধারে সরকারের খাস জমির উপর তালপাতার একটা ছোট্ট কুঁড়ে বানিয়ে সেখানে বাস করে। আকাশে মেঘ দেখলে ভয়ে তার জান শুকিয়ে যায়। যদি নিষ্ঠুর মেঘ করে, ঝড় এসে কিছু একটা করে বসে।

প্রকৃতির নিয়মে মনোজের চার সন্তান। মনোজের মতো ভূমিহীন মানুষের চার সন্তান হওয়া মানে বর্তমানে সেটা একটা সামাজিক অপরাধের মধ্যেই পড়ে। যদিও বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে মনোজকে অতগুলো বাচ্চা নিতে হয়েছে। কিন্তু মানুষ তো সেটা বুঝবে না। মানুষ বলবে, ওটা একটা সামাজিক অপরাধ।

দুই


মনোজের প্রথম সন্তান মেয়ে হলে তার স্ত্রী শুকতারার পুত্র সন্তানের বাসনা জন্মায়। স্ত্রীর শখ মেটাতে গিয়ে মনোজকে আবার বাচ্চা নিতে হয়। কিন্তু সেটা পুত্র সন্তান না হয়ে আবার একটা কন‍্যা সন্তান হয়। মনোজ তখন মনস্থির করে যে, আর কোনো সন্তান নয়। স্ত্রীর শখ হলেও আর নয়। কেননা, গরিবের সংসার। গরিবের সংসারে দুটোই বেশি। এরপর তিনটে হলে খুব বেশি হয়ে যাবে। লোকেও নিন্দা করবে। তাছাড়া অধিক সন্তান নিয়ে মানুষ করাটাও আজকাল খুব কষ্টের। আচ্ছা আচ্ছা বড়লোক যারা তারাই তো একটা-দুটোর বেশি বাচ্চা নিচ্ছে না। তাহলে সে নিতে যাবে কোন দুঃখে! না, সেও আর নেবেনা। নিয়ে বাড়িতে শুধু ছেলের পাল করে রাখলে তো হবেনা। তাদের মানুষ করতে হবে, সঠিকভাবে খেতে পরতে দিতে হবে, লেখাপড়া শেখাতে হবে। তবেই তো সন্তান বড় হয়ে বাবার নাম করবে। আর তখনই হবে সন্তান নেওয়ার সার্থকতা। তাছাড়া কোনো সার্থকতা নেই।

কিন্তু শুকতারা শোনেনা সেসব কথা। সে আবার বাচ্চা নিতে চায়। আর মনোজ চায়না। এই নিয়ে দু’জনের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়। শুকতারা তার বাপের বাড়ি চলে যায়। নিজ হাতে রান্না করে খেতে মনোজের তখন খুব কষ্ট হয়। ফলে শুকতারাকে সে আনতে যায়। কিন্তু শুকতারা আসতে চায়না। সে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেয় যে, আবার বাচ্চা নিলে তবেই সে আসবে, নচেৎ আসবে না। বাধ্য হয়ে মনোজকে তখন বলতেই হয়, ‘আবার বাচ্চা নেবো, চল।’

শুকতারা মনোজের সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু নিয়তির কী খেলা! আর একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। এরপর চার বারের বেলায় বাচ্চা নেওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে আবার গণ্ডগোল হয়। শুকতারা আবার বাপের বাড়ি চলে যায়। মনোজ তাকে আবার ধরে আনে। এবার তাদের একটা পুত্র সন্তান হয়। শুকতারার তো একটা পুত্র সন্তানেরই শখ ছিল। তার শখ পূরণ হয়। এরপর তারা আর কোনো বাচ্চা নেয়না। নেয়না তো নেয়না। দিদিমণিদের দেওয়া কন্ডোম আর বড়ি ব‍্যবহার করে তা বন্ধ করে রেখেছে।

তিন


পেশায় মনোজ ভ‍্যান চালক। ভ‍্যান চালিয়ে তার সংসার চলে। স্ত্রী-সন্তানদের প্রতিপালন করে। হঠাৎ লকডাউন শুরু হওয়ায় সে এখন ভীষণ বিপদে পড়ে গেছে। এক টাকা রোজগার নেই। ভ‍্যানটা নিয়ে কোথাও যে বেরোবে সে উপায়ও নেই। পুলিশ গ্রামের দিকেও চলে আসছে এবং এসে যদি বাড়ির বাইরে কাউকে দেখছে তো তার আর রক্ষে নেই। এমতাবস্থায় বাইরে বেরোনো যে সমীচীন নয় মনোজ সেটা বেশ ভালো করেই জানে। বেরিয়ে যে কাজ হবেনা সেটাও জানে। তবু মনোজের মন মানল না। ভ‍্যানটা নিয়ে সে একদিন বেরিয়েই পড়ল।


চার


ভ‍্যান নিয়ে মোড়ে গিয়ে সে যেই দাঁড়িয়েছে অমনি একটা পুলিশের গাড়ি সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে দুটো পুলিশ নামলো। পুলিশ দুটোকে নামতে দেখে মনোজ দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করল। না হলে তাকে যদি এসে খপ করে ধরে ফেলে! পুলিশ দুটোও তার পিছু ধাওয়া করল¾ ‘এই দাঁড়া, দাঁড়া,দাঁড়া বলছি…’ কিন্তু মনোজ দাঁড়ালো না। দৌড়াতে দৌড়াতে সে মাঠে নেমে পড়ল। পুলিশ দুটো তখন দাঁড়িয়ে গেল। মাঠে নামলো না। রাতে বৃষ্টি হয়েছে। মাঠে যে এখন কাদা। ইউনিফর্মে যে তাহলে কাদা লেগে যাবে। কিন্তু তারা বলতে ছাড়লো না, ‘শালা,বেঁচে গেলি যা, ধরতে পারলে আজ তোর যা করতাম না!’


পাঁচ


পুলিশের মার খুব সাংঘাতিক। পুলিশের মার যে একবার খেয়েছে সে কাল-গু হেগে মরেছে। অতএব মনোজ দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠের মধ্যে পালিয়ে গেল। যাতে এতদূর পর্যন্ত পুলিশ তাকে ধ‍রতে আবার তেড়ে না আসে এবং সেখানে গিয়ে সে ভিজে মাটিতে পা পিছলে পড়ে গেল। ‘আ! মরেছি গো!’ মনোজের মুখ থেকে তখন আপনি আর্ত চিৎকারটি বেরিয়ে এল। কিন্তু মনোজ তখন উঠল না। পড়ে পড়ে সে ভাবতে লাগল। সে যদি এখন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যেত তাহলে তার কী যে হতো! কী যে হতো! সে মারতে নিষেধ করলেও শুনত না, মারতই। মারতে মারতে তাকে আধমরা করে তবে ছাড়ত। যাক, পুলিশের হাতে যে ধরা পড়েনি সেটাই তার ভাগ্য।


ছয়


মনোজ এবার মাঠ থেকে উঠে বাড়ি চলে আসবে। তার আগে সে মাঠের চারদিকটা একবার তাকিয়ে দেখল। না, মাঠে কোনো জনমানুষ নেই। কাউকে দেখতে না পেলেও মনোজ তার পায়ের কাছে একটা জিনিস দেখতে পেল। চকচকে একটা জিনিস। জিনিসটার সামান্য অংশ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পুরোটাই নরম কাদার তলায় পু়ঁতে রয়েছে। জিনিসটা যে কী জিনিস সেটা দেখতে হলে কাদার তলা থেকে জিনিসটাকে উপরে তুলে আনতে হবে। অতএব মনোজ দুই হাত দিয়ে জায়গাটার কাদা সরাতে লাগল। সরাতে স‍রাতে জিনিসটা একসময় তার হাতে চলে এল। এলে পরে মনোজ সেটা গামছায় জড়িয়ে বাড়ি নিয়ে চলে এল। ঠিক যেভাবে ছেলেরা খালে বিলে মাছ ধরে সেই মাছ গামছায় করে জড়িয়ে বাড়ি নিয়ে আসে।

সাত


মনোজ বাড়ি এলে পরে শুকতারা তার দিকে তাকালো। তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কি মাছ ধরে আনলে?’

মনোজ বলল, ‘না।’

তাহলে মাছ ধরার মতো তোমার হাতে,পায়ে এত কাদা কেন?

এমনি।

গামছায় কী তাহলে?

একটা জিনিস আছে।

কী জিনিস আছে?

পুকুর থেকে আগে হাত, পায়ের কাদা ধুয়ে আসি। তারপর বলছি।

মনোজ পুকুর থেকে হাত,পায়ের কাদা ধুয়ে এসে বলল, ‘বালতিতে জল আছে?’

শুকতারা বলল, ‘আছে।’

মনোজ তখন গামছার বাঁধনটা আলগা করে দিয়ে সেই চকচকে জিনিসটা বালতির জলে ডুবিয়ে দিল। দেওয়ার পর বলল, ‘ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে জিনিসটা জল থেকে তোল। কাদা লেগে থাকেনা যেন।’

শুকতারা তাই করল। পরে মনোজ বলল, ‘কী জিনিস এবার দ‍্যাখ!’

শুকতারা জিনিসটা দেখে বলল, ‘এ যে খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরি দুর্গা ঠাকুরের মূর্তি গো! তুমি কোথায় পেলে? এর যে অনেক টাকা দাম! অনেক অনেক টাকা দাম!’

মনোজ এবার ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে বলল, ‘আস্তে!’

খুব আস্তে এবং নিচু গলায় শুকতারা বলল, ‘কোথায় পেলে?’

মনোজ বলল, ‘কুড়িয়ে পেলাম।‘

কোথায় কুড়িয়ে পেলে?

মাঠে।

মাঠে তুমি কী করতে গিয়েছিলে?

পুরো ঘটনাটা মনোজ তখন শুকতারাকে খুলে বলল।কিছু গোপন করল না।


ঘটনার বিশদ বর্ণনা শুনে শুকতারা বুঝে নিল যে, এটা দুর্গা ঠাকুরের একান্ত আশীর্বাদ। তার আশীর্বাদ ছাড়া এতবড় প্রাপ্তি কখনোই সম্ভব নয়। অতএব সে আর দেরি করল না। তক্ষুনি দুর্গা ঠাকুরের স্মরণ করল।- ‘তোমাকে ধন্যবাদ ঠাকুর, অনেক ধন্যবাদ। অনেক অনেক ধন্যবাদ।’ শুধু শুকতারা নয়, মনোজও স্মরণ করল। অতঃপর আমরা আশা রাখব, মনোজের সংসারে একদিন সুখ আসবে। জীবনের দৈন‍্যতা দূর হবে। হবেই হবে।


ছবি : সংগৃহীত

 
 
 

Comments


1111-removebg-preview.png

গল্পের বই উপহার পেতে কে না চায়!
এখনই Subscribe  করুন,
আর পেয়ে যান আপনার প্রথম বইটির মূদ্রিত মূল্যের ওপর ২৫% ছাড় 

Thanks for being our family!

  • Youtube
  • pngwing.com
  • 1111
  • tumblr
  • Instagram LOGO PNG2

+91 8240333741

Magic Seeds Books LLP

119 Abhay Patuli Lane, Shuksanatantala, Chandannagar 712136

Email us at: manikarnika.pub@gmail.com

For any other queries feel free to reach us at: 8240333741(Call/Whatsapp)

©2022 by Manikarnika Prakashani.

bottom of page