চিরসখা হে । আবীর ভট্টাচার্য্য
- manikarnikapub
- Nov 11, 2022
- 11 min read

দিন শেষের রাঙা মুকুল জাগলো চিতে
সন্ধ্যে থেকেই চলছে অঝোর ধারাপাত। বৈশাখ শেষে এমন বৃষ্টিপাত সচরাচর দেখা যায় না, সারা আকাশের আকুল উদ্বেগ যেন কান্নাবারি হয়ে অস্ফুট অম্বুদে ঝরে পড়ছে মাটির বুকে।
মধ্য কোলকাতার এক খানদানি নার্সিংহোমের লাউঞ্জে পাশাপাশি বসে থাকা দুই সমবয়সিনী নারীর মনের অবস্থাও হয়তো এমন সন্ধ্যেটির মতোই। দুইজনের প্রথমজন ডঃ গার্গী মুখোপাধ্যায়। কোলকাতার এক বিখ্যাত M.N.C-এর উচ্চপদে কর্মরতা। দীর্ঘাঙ্গী নির্মেদ শরীর জুড়ে আত্মবিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠার দ্যুতি, নাক-কান-আঙুল বন্ধনীর হীরককুচিগুলিকেও ম্লান করে দিচ্ছে। পরনে ক্যাজুয়্যাল অফিস ড্রেস, চোখে রিমলেস চশমা, উজ্জ্বল গমরঙা ত্বকের অধিকারিনীর উপস্হিতির মধ্যে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বপ্রভা।
অন্যদিকে পাশে বসা নিপাট ভালোমানুষ সুন্দরী মধ্যবয়সিনীর পৃথু-শিথিল শরীরে মাত্রাতিরিক্ত বিলাসিতা ও সৌভাগ্যের বিভা। একাধিক দুর্মূল্য গহনা, অঙ্গের দামী শাড়ি, ফেসিয়াল চর্চিত ফর্সা কপালটির মধ্যিখানে টুকটুকে লাল সিঁদুর টিপশোভিত তিনি রঞ্জনা। ডঃ অনীশ রায়ের স্ত্রী। আর গার্গী?
সে গল্পে না হয় আর একটু পরে আসি। এখন দেখি, আজ দুজনেই কেন এখানে এসে বসে আছেন একটি মানুষেরই জন্য!
মানুষটি ডঃ অনীশ রায়। কোলকাতা সংলগ্ন একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, অসম্ভব ছাত্রদরদী এক জনপ্রিয় শিক্ষক। হঠাৎ আজ বিকেলে কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পরে, ছাত্রদের পড়াতে পড়াতেই তুমুল অসুস্থ হয়ে পড়েন; অস্বাভাবিক ঘামতে ঘামতে জ্ঞান হারান। পাড়ার স্হানীয় ডক্টর গুরুতর কিছু সন্দেহ করে, প্রাথমিক চিকিৎসা পরিসেবাটুকু দিয়েই বড়ো কোথাও ট্রান্সফার করার কথা বলেন।
উনি নিঃসন্তান হলেও সর্বজনপ্রিয় গুণী মানুষটির পাড়া-প্রতিবেশী, সহকর্মী আর ছাত্রছাত্রীরা সবাই মিলে প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই দায়িত্ব নিয়ে তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। এখানে আসার পথে কিংকর্তব্যবিমূঢ় রঞ্জনা কি মনে করে যেন খবর দিয়েছিলেন গার্গীকে। উনিও পৌঁছে গিয়েছিলেন তৎক্ষণাৎ, এবং যথার্থ চিকিৎসার সুব্যবস্থাও হয়েছে তাঁরই কল্যাণে। এখানে বসে রঞ্জনার কাছে শুনলেন, বেশ কয়েকদিন ধরেই নাকি বুকে চাপ অনুভব করছিলেন। বিশেষত রাত্রির দিকে। হজমের সমস্যা বলে কাটিয়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু আদপে সমস্যা গুরুতর। এখানে আনার পরেই অ্যঞ্জিওগ্রাম করে দেখা গেছে, বাহ্যিক চলাফেরা যত স্বাভাবিকই থাক না কেন, ভদ্রলোকের স্নেহাতুর মনটির মতোই তাঁর আন্তর্যন্ত্রীয় রক্ত চলাচলপথগুলি ক্রমশঃ স্নেহভারে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। অবস্থা এমন জটিল যে, এখনই অ্যঞ্জিওপ্লাষ্টি না করলে সমূহ বিপদ এবং গার্গীর উপরোধে আজ রাতেই তা করার ব্যবস্থা হচ্ছে। পরিস্থিতি যথেষ্ট জটিল এবং উদ্বেগজনক; অপারেশন করার পরের বাহাত্তর ঘন্টাও বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। সামনে কঠিন লড়াই, বেশ কয়েকদিনের। তাই ছাত্রছাত্রী, বন্ধু-পরিজনদের আজকের মতো বুঝিয়ে-সুজিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে আত্মীয়া দুজন লাউঞ্জে এসে বসেছিলেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে রাতটুকু ওখানেই কাটাতে হবে, এই ভেবে।
আজকালকার নার্সিংহোমগুলি রুগীর আত্মীয়দেরও খানিক পরিসেবা দেয়, যথেষ্ট আরামদায়ক বসার জায়গা এবং ইচ্ছে করলে সংলগ্ন ক্যান্টিনে কিছু খাওয়া-দাওয়ারও ব্যবস্থা আছে। ওখান থেকেই বোধহয় দুকাপ কফি দিয়ে গিয়েছিল কেউ, খেতে চাইছিলেন না দিশেহারা রঞ্জনা। তখন থেকেই কেঁদেকেটে বিশ্রী কাণ্ড করে চলেছেন। মৃদু ধমক দিয়ে পাশে বসে কফিটুকু জোর করে খাওয়ালেন গার্গী, নিজেও খেলেন। সত্যিই, এককাপ কফি যে কতখানি স্বস্তিদায়ক এমন সব বিপদের দিনে, খেতে খেতে ভাবছিলেন। অথচ কফি তাঁর একেবারেই প্রিয় নয়, এই কফির জন্যই যে বড়ো অশান্তি এসেছিল জীবনে; স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে আজ কত কথা!
স্বপনবাধা টুটি ,বাহিরে এল ছুটি
অবাক আঁখি দুটি হেরিল তারে…
অনীশ এবং গার্গী ছিলেন বাল্যবন্ধু, একই পাড়ায় তাদের পৈতৃক নিবাস। দুজনেই মা-বাবার একমাত্র সন্তান এবং একসাথেই কেটেছে নার্সারি থেকে ইউনিভার্সিটি। পাড়ার ফাংশনে, খেলার মাঠে, কোচিং বা টিউশনির ক্লাসে স্বাভাবিকভাবেই তারা ছিলেন সদাসঙ্গী। তাদের বাবা এবং মায়েরাও ছিলেন পাড়াতুতো সম্পর্কে বন্ধু, স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশার এবং যত্নের অভাব দুপক্ষ থেকেই কখনও হয়নি। উপরন্তু দুজনেই শৈশব থেকে একজোড়া নয়, দুজোড়া মা-বাবার আশ্রয় ও প্রশ্রয় পেয়েছেন মনভরে। এর ফলে ওনাদের দুজনের মনেই দুজনের সম্পর্কে একটি নামহীন অবিকল্প বন্ধন তৈরি হয়েছিল। যে যার মা-বাবাও তাতে অল্পস্বল্প ইন্ধন যুগিয়েছিলেন। তাই ছোটোবেলায় পড়ে গেলে সবার আগে তুলতে আসা, কিশোরীবেলায় গার্গীকে কেউ বিরক্ত করলে বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে অনীশের তাকে কড়কে দিয়ে আসা, শরীর খারাপ হলে নোটপত্তর ঠিক সময়ে পরস্পরের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া বা নবযৌবনবেলায় গার্গীর স্কুলব্যাগে অনীশের নিরাপদে সিগারেট প্যাকেট লুকিয়ে রাখা... এসব চলতই।
আসলে আশৈশবই ওরা দুজনে ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু; স্ত্রী-পুরুষ নয়, শুধুই বন্ধু। যে অমূল্য সম্পর্কবন্ধনের অধিকারে পরস্পরের কাছে সময়-অসময় নেই, রাত-দিনের বাধা নেই, দ্বিধা বা সঙ্কোচ কিছুই নেই; যখন খুশি, যেভাবে খুশি, মানে-অভিমানে নামানো যায় হৃদয়ভার। তাই স্কুলে তুমুল ঝগড়াঝাটির পরেও, না বলেই তার ব্যাগ থেকে নিয়ে খাওয়া যায় টিফিন বা ক্যাডবেরি, অঙ্ক না পারলে চুপচাপ খাতা টেনে দেখিয়ে দেওয়া যায়, ডিবেট বা আবৃত্তির সময় উচ্চারণ বা প্রকাশভঙ্গির অসঙ্গতি অনায়াসে শুধরে দেওয়া যায়, কিশোরীবেলার সেই সেই কষ্টের দিনে নিঃসঙ্কোচে চোখ বন্ধ করে কাঁধে মাথা রাখা যায়, কারণে-অকারণে মাথায় গাঁট্টা মেরে বুদ্ধু বলা যায়। এমনকি পরস্পরের ওপরে অভিমান হলে তাকেই প্রথম তা জানাতে হয়। আরও যা যা সব করা যায়, সেসব নিয়েই পূর্ণ ছিল সেসব সোনা দিন।
তাই নববসন্ত সমাগমে কিশোরী গার্গীর সর্বাঙ্গের অরুণ উন্মেষ খুব গোপনে আর পাঁচজন ছেলেবন্ধুর মুগ্ধ দৃষ্টির অব্যক্ত নরম আদরে যখন আশরীর অভিসিক্ত হচ্ছিল অথবা শ্যামকান্তি অনীশের নাকের তলা বা অনূঢ় কপোলে নবদূর্বাদল পৌরুষ-কোরকের কৌলিন্যে অন্য বন্ধুদের মন শীত-সকালের আমলকী-শিহরে কেঁপে উঠছিল; এদের দুজনের সেদিকে মনই পড়েনি কখনও। বরং ভাঙা কন্ঠস্বরের বেসুর-অস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কেউ যখন অনীশকে ডিবেট বা ক্যুইজ পার্টনার করতে রাজিই হতো না, ওরা দুজন কিন্তু সবসময়েই একসঙ্গে যেত। বিতর্কে-বন্ধুত্বে-সাহচর্যে বেশ কেটে যেত সেই সব সোনা দিন।
তারও পরে, আরও একটু বড়ো হলে তাদের অভিভাবকেরা হাবেভাবে বোঝাতেন এবং ওরা দুজনেই বেশ বুঝে গিয়েছিল, বড়ো হয়ে তাদের বিয়ে হবে। এই ইচ্ছে তাদের মা-বাবার। এটা যেন বড়ো হওয়ার মতোই স্বতঃসিদ্ধ। মনে আছে, সেই সেবার পুজোর ছুটিতে ওরা দুই পরিবারের সবাই মিলে ভাইজ্যাক বেড়াতে গিয়েছিল। ওরা দুজনেই তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আরাকু ভ্যালির উচ্চাবচ কফিবনের গভীরে সেই বিখ্যাত গুহার বাদুড়-ওড়া ভিজে ভিজে অন্ধকার সিঁড়িতে, বিজলী বাতির নকল স্তম্ভালোকে ঝিকমিকিয়ে ওঠা স্ট্যালাকটাইট-স্ট্যালাকমাইটের স্বপ্নিল আবছায়ায় হাত ধরাধরি করে নামতে নামতে অনীশ গার্গীকে বলেছিল, ‘জানিস, ওরা চারজনে মিলেই চায় আমরা আজীবন এমন করেই হাত ধরে পথ চলি।’
বাবা-মায়েরা ছিলেন ওদের থেকে অনেকখানি পিছনে। নবযৌবনা গার্গী হঠাৎ এমন অতর্কিত প্রেম-প্রস্তাবে বোধহয় একটু লজ্জা পেয়েছিল, তবু বাইরে স্মার্টনেস দেখিয়ে বলেছিল, ‘আমি ওসব নিয়ে ভাবিনি কখনও। বাবা-মা যা ভালো বুঝবে…’
বুদ্ধু একটা! বিয়ে করবি তুই, আর সেসব নিয়ে ভাবনা মা-বাবার! বলনা! বিয়ে করবি আমায়?
সে গলায় এমন কিছু ছিল, মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কথাটি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল নওলকিশোরী। ছোট্ট টিলার শির থেকে নেমে আসা তিরতিরে ঝর্ণাঝরা গলায় অন্তরতম কেউ যেন বলে উঠেছিল, ‘করতে পারি, যদি সবসময়েই এমনি করে ধরে রাখিস হাত…’
রাখব রে!
ব্যস। এটুকুই। আর কোনো কথা হয়নি কোনোদিন ওদের এইসব ব্যপারে। দিনরাত একসঙ্গে পড়াশোনা, গল্পগাছা, এডুকেশনাল ট্যুর সব চলেছে হাতে হাত ধরে; পারস্পরিক নির্ভরতাও দিন দিন বেড়েছে। ঘটা করে বন্ধুত্বের মধ্যে প্রেমবিলাসের উদযাপন করতে হয়নি। তাই চমৎকার কেরিয়ারের সঙ্গে সঙ্গে কোনো জটিলতা বা আবর্ত ছাড়াই বন্ধুত্ব প্রেমে গড়িয়েছে, প্রেম দাম্পত্যে। ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন অভিভাবকেরা।
তারপর? কোন এক উতল বাসন্তী সন্ধ্যায়, মৃগশিরা নক্ষত্রের বিহ্বল আহ্বানে, পরস্পরের মোহমাধুরী মনে মেখে, কেয়ুর-কুঙ্কুম চর্চিত নবদাম্পত্য এল দুই প্রিয়বন্ধুর জীবনে। প্রথম প্রথম ভালোই চলেছে সব, দুজনের কেরিয়ার গ্রাফে নতুন নতুন পালক,পরস্পরকে ঠিকঠাক সহায়তা, বছরে একবার বিদেশভ্রমণ, মোহময় রমনসুখ… সবই ছিল এক্কেবারে ঠিকঠাক; যাকে বলে ঈর্ষণীয় জীবন।
তবু সব ভালো তো চিরকাল শুধু ভালোই হয় না। বিবাহের বর্ষপূর্তির আগেই দাম্পত্য আর বন্ধুত্ব যে ঠিক এক নয়, তা তাদের দুজনেরই মনে হতে লাগল। ছোটো থেকে যা কখনও হয়নি, পরস্পর পরস্পরকে ভুল বুঝতে লাগল, ক্রমে কখনও কখনও বিছানা আলাদা হতে লাগল। অভিমানে, অসন্তোষে। তার ছায়া পড়ল উভয়ের মনেও। দুজনেরই মনে হতে লাগল, দাম্পত্য বন্ধুত্ব নয়, অন্য কোন অনুভব, যা হয়তো বুকের নিরালা গভীরে ফুটে ওঠা নিভৃত নীল পদ্মসৌরভের মতো পুরুষ-প্রকৃতিকে রোমাঞ্চ দেয়, প্রতিদিনের নয়নতারার প্রিয়-আসঙ্গে তার মুক্তি কই!
একদিকে কেরিয়ারের চাপ, তুমুল ব্যস্ততা, মন কষাকষি হলেও সৌজন্যবশত বাড়ি ফিরেও ঝগড়াঝাটি করতে না পারা, দুইবাড়ির অভিভাবকদের ক্রমাগত সম্পর্কে অনুপ্রবেশ... এসব নিয়ে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছিল। এরমধ্যেই এক একদিন অফিস পিকনিকে কোন একজন সহকর্মিনীর সঙ্গে অনীশের অন্তরঙ্গ হাসিমুখের ছবি অথবা বসের সঙ্গে গভীররাতে গার্গীর অফিসিয়াল কনভারসেশন তাতে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছিল…
আসলে ওরা দুজনেই ছিল মা-বাবার প্যম্পার্ড চাইল্ড। ওদের সম্পর্কও কখনও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যায়নি। তাই ওরা জানতই না, আধুনিক সম্পর্কে স্পেস কতখানি জরুরি। দুটি ভালো মানুষ, ভালো বন্ধু হলেও ভালো স্বামী বা স্ত্রী হয় না; তারজন্য অনুশীলন প্রয়োজন। তাই ফাল্গুনের কোন এক উতল সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে, অনীশ তখন অফিসের কাজ নিয়ে তুমুল ব্যস্ত, গার্গীর হঠাৎ ইচ্ছে হয়েছিল একসঙ্গে একটু বেড়াতে যাওয়ার, কফি খাওয়ার। যদিও কফি ওর একেবারেই পছন্দসই নয়। তবু হঠাৎ বাসন্তী হাওয়ায় আন্দোলিত মন নিয়ে অভিসারিকা এসেছিলো প্রিয়সকাশে; ইচ্ছে, প্রেমবিলাস। দুকাপ কফি এনে অনীশের কাছে আবদার করল, ‘অনেকদিন ক্যাফেটেরিয়া যাওয়া হয়নি। চল না আজ একটু এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে কফি খেয়ে আসি!’ অন্যান্য দিন হলে, অনীশ বুঝিয়ে বলত সমস্যার কথা। গার্গীও মেনে নিত। গার্গীর ব্যস্ততাকেও একইভাবে, অনীশ সম্মান দিয়েছে সচরাচর। কিন্তু সেদিন দুপুর থেকেই ওদের এক পুরোনো বান্ধবীর হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাসে এক টেবিলে বসা অনীশের সঙ্গে বান্ধবীটির কফি খাওয়ার হাসিমুখের ছবি গার্গীর মাথায় এক বিশ্রী বিবমিষার উৎপাত শুরু করেছিল। স্বভাব বিরুদ্ধভাবেই হঠাৎ তিতিবিরক্ত কন্ঠে বলে উঠেছিল, ‘তা আমার সঙ্গে যাবি কেন? তোর এখন কত বন্ধু হয়েছে, আমাকে আর ভালো লাগে না, বল?’
এখনও মনে আছে, অনীশ হতবাক হয়ে ওর দিকে খানিক তাকিয়ে রইল। যে গার্গীকে সে চেনে, যে গার্গী ওর প্রাণের সখী, এ তো সে নয়; এ তবে কে?
তবে গার্গীর মাথায় তখন তো ঈর্ষাবিষের জ্বলন, সাপিনীর হিসহিসে কন্ঠে আরও কি কি যে কথা শুনিয়েছিল, মনে নেই; শুধু মনে আছে,অনীশ প্রচন্ড রাগে কাঁপতে কাঁপতে একসময় কফির ট্রে-টা উল্টে দিয়েছিলো, সারা ঘরে ভাঙা কাপের কাঁচকুচি আর কফি ছড়িয়ে গেল…
প্রবল চিৎকার শুনে আন্টি এসে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন,ওদের হয়তো থামাবার চেষ্টাও করেছিলেন; কিন্তু সে মুহূর্তে ওদের শোভনতার হুঁশ ছিল না।
খানিক পরেই বাহ্যজ্ঞানশূন্য ও রিপুতাড়িত গার্গীও বাড়ি ছেড়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল। একপাড়ায় বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও যেটা বিয়ের পরেও কখনও করেনি। আঙ্কেল-আন্টি অনেকবার সাধাসাধি করেছিলেন। বারণ করেছিলেন যেতে। অনীশ একবারও না। গার্গীও রাগ করে ওখানেই রয়ে গেল, আর ফিরলই না। সূর্য উঠল, সূর্য ডুবল; চক্রায়িত দিনরাত্রি, সব চলতে লাগল নিজের মতো। শুধু দুটি জীবনে তার সুষম ছন্দ আর তার সুখ-ছায়া ফেলতে পারল না।
আমারে পড়িবে মনে কখন সে লাগি
প্রহরে প্রহরে আমি গান গেয়ে জাগি।
বাইরের ঝরো ঝরো বৃষ্টির অন্ধকারে, অতীতচারী গার্গীর মনে পড়ছিল এমনই আরও এক ফেলে আসা দিনের কথা। তুমুল অশান্তির শেষে পাকাপাকি ভাবে নিজের বাবা-মায়ের কাছে ফিরে এসেছেন তখন কয়েকদিন আগেই। ও বাড়ির আঙ্কেল-আন্টি দেখা করে গিয়েছেন, যোগাযোগ রাখছেন, বাবা-মাও কোনোরকম সমস্যা করছেন না, সময় দিচ্ছেন তাঁকে। দুপক্ষের বাবা-মাই ভাবছেন, ওদের দুজনের কয়েকদিন আলাদা থাকা উচিত। একটু যতি প্রয়োজন। অফিসেও কয়েকদিন ছুটি নিয়েছেন গার্গী। নিজের মতো কাটছে দিন, গান শুনে, জানলাপারে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিজের সঙ্গে কথা বলে।
সেদিনও সকালে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বারান্দায়। হঠাৎ সেই চিরপরিচিত বুলেটের শব্দ... ভুটভুট...ভুটভুট…
এই সময়েই সে রোজ যায় এপথে অফিসে; এতদিন পেছনের সীটে গার্গীর জায়গা ছিল, সীটটি এখন ফাঁকা। এখনও মনে পড়ে, বুকটা কেমন যেন হু হু করে উঠেছিল হঠাৎ। সেই প্রথম মনে হয়েছিল, আজন্মের প্রিয়বন্ধুটির সঙ্গ তাঁর ভালো থাকার জন্য কতখানি জরুরী। বেশ তো ছিলেন, কেন যে এমন করে সব ওলট-পালট হয়ে গেল…
একরাশ মনখারাপ যেন কালবৈশাখীর অশান্ত অশনির মতো গার্গীর মনকে তছনছ করে দিচ্ছিল, কী ভীষণ এক অবসন্নতায় ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন; ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কি সব আবোল তাবোল স্বপ্নও দেখেছিলেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙেছিল ফোনের রিংটোনে... অনীশ আদর করে তাঁর রিংটোনে নিজের হেড়ে গলায় ‘ও আমার গোলাপবালা…’ গানটি সেট করে দিয়েছিলেন। তীব্রতর অনিচ্ছায়, কেমন এক মনকেমনিয়া টানে আধো ঘুমঘোরে ফোন তুলতেই সেই প্রিয় কন্ঠ! মনে হয়েছিল, স্বপ্ন দেখছেন নাকি!
চোখ রগড়ে একটু সচেতন হয়ে, আবার কান পাতলেন ফোনে…
‘কেমন আছিস?’
গলাটা কেমন যেন ব্যথাব্যথা করছিল, চোখেও যেন কী একটা পড়ে খুব জ্বালা করছিল। বুকে অযুত হাতুড়ির ঘা, সারা শরীর জুড়ে প্রজাপতির ওড়াউড়ি; মনেই পড়ল না, কয়েকদিন আগেই তুমুল ঝগড়াঝাটি করে ফিরে এসেছেন গার্গী নিজের বাড়িতে। তবু মনের উত্তেজনা প্রশমন করে জানতে চাইলেন প্রোষিতভর্তিকা,‘ফোন করেছ কেন?’
একবার দেখা করতে চাই। অফিস থেকে ফেরার পথে আসবি সন্ধ্যায় গঙ্গার ঘাটে?
আসব।
সাড়ে পাঁচটায়। আমি অপেক্ষা করবো।
সে অর্থে কলকাতায় মানুষ হলেও কখনও গার্গী তেমন এদিকে-ওদিকে যেতে অভ্যস্ত ছিলেন না, প্রয়োজনও পড়েনি তেমন। আর সেই সময় তো মনমেজাজও তেমন ভালো না। কিন্তু অনীশের ডাক অস্বীকার করার সাধ্য তো গার্গীর নেই। সেদিন না, আজও না। অগত্যা...
গঙ্গার ঘাটে গিয়ে যখন পৌঁছলেন,সন্ধ্যা নামতে বেশী দেরি নেই। আকাশে অস্তগামী সূর্যের আলো, পাখিরা সব বাড়ি ফিরছে। একটু এদিক-ওদিক চোখ ফিরিয়ে দেখলেন। নদীর জল একাকী ছলোছলো শব্দে বয়ে চলেছে। সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে রয়েছেন অনীশ; বাহ্যজ্ঞানরহিত হয়েই। গার্গী নিঃশব্দে এসে বসলেন তাঁর পাশে। তেমন খেয়াল করলেন না অনীশ। উনিও জানান দিলেন না তাঁর উপস্হিতি। বেশ খানিকক্ষণ পরে অনীশ শুরু করলেন কথা।
কেমন আছিস?
কী বলবে বলে ডেকেছ বলো!
গার্গী আশৈশব অনীশকে তুই বলেই ডাকেন। বিয়ের পরে, গুরুজনদের নির্দেশে তুমি বলা শুরু করেছিলেন। সেদিনও কেন যেন ঐ ঘেরাটোপ থেকে বার হতে পারলেন না তিনি। এখনও মনে আছে, অনীশ একবার তাঁর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। তারপরে চোখ সরিয়ে কখনও নদীর দিকে, কখনও বা পাশের মাটিতে আঙুল দিয়ে এলোমেলো আঁকিবুঁকি কেটে চলেছিলেন। নদীর এলোপাথাড়ি হাওয়ায় ওঁরই উপহার দেওয়া অনীশের গায়ের পারফিউমের গন্ধ গার্গীর নাকে এসে লাগছিল, বিবশ করে দিচ্ছিল, আর মনে হচ্ছিল সামনে বসে থাকা কাছের মানুষটি আজ কতো দূরে… কখনো কখনো হাতের নাগালের সম্পদ মনের নাগাল পায় না যে! মনে আছে, তারও খানিক পরে, একসময় নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে কথা শুরু করলেন অনীশ। বললেন,‘আমি ভেবে দেখলাম, এভাবে হয়না।’
কী হয় না, বুঝতে না পেরে নিশ্চুপ রইলেন সবসময়েই বকবক করা গার্গী। আরও খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে অনীশ হঠাৎ ওর হাতদুটি জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘মুক্তি দে। মুক্তি দে আমায়।’
চমকে তাকিয়ে গার্গী দেখেছিলেন, অনীশের সারামুখ ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে। কী ভীষণ এক ব্যথা ঘনিয়ে আছে অশ্রুভারাতুর চোখদুটিতে। ছোট্ট থেকেই অনীশকে অদেয় গার্গীর কিছুই নেই, আর এ তো সামান্য মুক্তি...
বেশ। কাগজ পাঠিয়ে দিও, সই করে দেব।— অভিমান ঘনিয়েছিল কন্ঠভরে।
তুই আমায় এই বুঝলি? আমি ডিভোর্স চাইছি?
তবে?
দুহাত বাড়িয়ে অনীশ ডাক দিল।
ফিরে আয় বন্ধু আমার! এসব বর-বৌ খেলা আমাদের জন্য নয়। প্রতি মুহূর্তে ভেঙে যাচ্ছি আমরা, শেষ হয়ে যাচ্ছি। বুঝতে পারছিস না?
কিন্তু উপায়?
মুক্তি দে। বেরিয়ে আয় এসব থেকে। আবার আমরা বন্ধু হই চল!
গার্গীর পরিণত নারীমন জানে, তা অসম্ভব। একবার কোনো সম্পর্কের বন্ধনে জড়িয়ে পড়লে, তা থেকে মুক্তি অতোটাও সহজ নয়। তবু অনীশ যা চায়, তাই তো করতে হবে তাঁকে জীবনভর। এ তার ভবিতব্য। এবং গার্গী জানেন, যাই হোক না কেন, অনীশের কথা বা শর্ত মেনে নিতেই হবে। চুপ করেই রইলেন গার্গী। একাই কথা বলে গেলেন অনীশ। তার সমস্যার কথা, প্রাথমিক মুগ্ধতা বা রোমাঞ্চ পেরিয়ে তার একঘেয়েমির কথা, প্রিয়বন্ধুর মায়াময়তার সঙ্গে প্রতিদিনকার রক্তমাংসের প্রাত্যহিকতাকে গুলিয়ে ফেলার নিঃসহায়তার কথা। আরও কী কী কথা হয়েছিল, আজ আর মনে নেই। শুধু মনে আছে, বিচ্ছেদ অবসম্ভাবী জেনেও কেন কে জানে, প্রিয়-আসঙ্গে তা শান্তিবহ মনে হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই বলে উঠতে পারছিলেন না গার্গী। বন্ধুত্বের মতো দাম্পত্যও শুধুমাত্র কোনো সম্পর্ক নয়, তা অন্য কোনো এক মহতী অনুভব— যাকে লালন করতে হয় প্রতিদিনকার অভ্যস্ত দিনযাপনের কাকলী-কলহ-মন্ডিত লাভ-ক্ষতির তেল-হলুদের বাইরে, গভীররাতে ফুটে ওঠা নিশিগন্ধার মতোই নিভৃত উৎসারে।
সামনের স্বপ্রবাহিতা জলধারার ওপারের আদিগন্ত আকাশের লালিমা তখন ধীরে ধীরে সীসেরঙ ধরছে। একটি দুটি তারা ফুটে উঠছে আকাশপটে। তার অস্পষ্ট অবয়বগুলি নদীজলে ভেঙে ভেঙে মিশে যাচ্ছে। গার্গী-অনীশের আজন্মের চিরচেনা যাপনও বুঝি রঙ হারাচ্ছে, তবু চিরায়মানা আবহমানতায় গেয়ে উঠেছিলেন গার্গী স্হলিতস্বরে—
‘মিলাব নয়ন তব নয়নের সাথে,
মিলাব এ হাত তব দক্ষিণহাতে—
প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।
হৃদয়পাত্র সুধায় পূর্ণ হবে,
তিমির কাঁপিবে গভীর আলোর রবে…’
গান শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও হাতে হাত রেখে দুজনে ওখানেই বসেছিলেন। দুজনেরই মনে পড়ছিল, হয়তো Robert Browning-এর ‘The Last Ride Together’— এর কয়েকটি চরণ,
‘The instant made eternity,—
And heaven just prove that I and she
Ride, ride together, for ever ride?’
যেন আমার গানের শেষে
থামতে পারি সমে এসে…
তারপরে, একসময় দুজনে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। বাড়িতে জানিয়েছিলেন সিদ্ধান্তের কথা। প্রথমে অভিভাবকদের তুমুল কান্নাকাটি, অশান্তি, মান-অভিমান; পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবদের তির্যক মন্তব্য; সব পেরিয়ে এসে দুপক্ষের অভিভাবকরাই একসময় বুঝতে পেরেছিলেন, ছেলেমেয়েরা সিদ্ধান্তে অনড়; তাঁরা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই গার্গীর, প্রথাগত না হলেও সেদিনের সেই সিদ্ধান্ত কিন্তু অনীশের একেবারে সঠিক ছিল। এই যে আজও, এতদিন পরেও প্রিয়বন্ধুর জন্য অন্তহীন আকুলতা। প্রতিদিনের ক্ষুদ্রতায় তা হয়তো মাধুরী হারাত।
তারও পরে কেটে গেছে কতদিন। যে যার বাড়িতে থেকেছেন, জীবনযাপন করেছেন নিজের নিজের মতো, অনিয়মিত হলেও হার্দ্যিক যোগাযোগ থেকেছে কোন অধিকারবোধ ছাড়াই; দুপক্ষের বাবা-মাই গত হয়েছেন কালের নিয়মে, পিতৃ-মাতৃহারা অবসাদগ্রস্হ গার্গীকে আবার পুরোনো জীবনে ফিরিয়ে আনতে যথাবিহিত সঙ্গদান করেছেন অনীশ, বিদেশে বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ দুর্ঘটনার কবলে পড়া গার্গীকে নিজের দায়িত্বে ফিরিয়ে এনে সুচিকিৎসা করিয়েছেন। সবসময়েই পাশে থেকেছেন প্রকৃত বন্ধুর মতো। সব মনে পড়ছে গার্গীর; জলছবির মতো। এও মনে পড়ছে, অনীশের জীবনে তারও অনেক পরে, একসময়ে রঞ্জনা এসেছেন। ওনারা বিবাহ করেছেন, সামান্য আলাপ এবং সদ্ভাব হয়েছে রঞ্জনার সঙ্গেও। গার্গীও ভালো আছেন। স্বপ্রতিষ্ঠিত নিজস্ব স্বাধীনতায়; শুধু অন্য কাউকে আর নিজের জীবনে আসতে দেননি।
এই সব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে কখন যে খানিক তন্দ্রা নেমে এসেছিল চোখের পাতায়, জানেন না। ঘুম ভাঙল রঞ্জনার কোমল হাতের স্পর্শে। চেয়ে দেখলেন, দুটি আকুল ভয়ার্ত আঁখি তাকিয়ে রয়েছে তাঁর দিকে। ইন্টারকমে ঘোষনা হচ্ছে, ‘কেবিন নম্বর দুইয়ের বাড়ির লোক থাকলে রিসেপশনে দেখা করুন।’
তন্দ্রালস ভেঙে, কী যেন এক অমঙ্গল আশঙ্কায় রঞ্জনাকে নিয়ে ত্রস্তপদে এগিয়ে গেলেন গার্গী। রিসেপশনে গিয়ে অবশ্য শুনলেন, রুগীকে অপারেশন শেষে বেডে দেওয়া হয়েছে। অপারেশন সাকসেসফুল। তবে এখনও সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত তিনি নন। চাইলে দূর থেকে দেখতে পারেন। রিসেপশনিস্ট মেয়েটির দেখিয়ে দেওয়া পথে এগিয়ে কাঁচের জানালার ঘেরাটোপে সার সার বেড দেখতে পেলেন। তারমধ্যে আপন মানুষটিকে চিনে নিতে অসুবিধে হল না দুই নারীর।
সাদা চাদরে সর্বাঙ্গ ঢাকা। অক্সিজেন, স্যালাইন এবং আরও কয়েকটি নল সারাশরীর জুড়ে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে। স্হির নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছেন চটপটে মানুষটি। দেখেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন রঞ্জনা। গার্গীরও চোখ পুড়ে যাচ্ছিল কষ্টে। তবু নিজেকে সামলে রঞ্জনাকে বুকে টেনে নিলেন।
বেশ খানিক ধারাবরিষন শেষে মেঘমুক্ত বৈশাখী আকাশে তখন স্বাতী নক্ষত্রের জল গোপন সংরাগে বশিষ্ঠ-অরূন্ধতী যুগল-তারার পবিত্র আলোর সম্মুখে প্রিয়কল্যাণে ঝরে পড়ছে নিঃশব্দে, চাঁদের আলোয় যেন কোনো ভুলে যাওয়া গৌড়-সারঙের ধুন; দুটি সমব্যথী প্রিয়াপ্রাণের প্রার্থনা সেই কোন অজানা ঈশ্বরের কাছে নিবেদিত হয়ে চলল শব্দহীন উপচারে তাদের একমাত্র প্রাণাধিক দয়িতের জন্যই।
বেশ খানিকক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পরে, অ্যাটেন্ডেন্টের অনুরোধে ফিরে এলেন আগের জায়গায়। রঞ্জনাকে বসিয়ে গার্গী এগিয়ে গেলেন ওয়াশরুমের দিকে। তুমুল দুশ্চিন্তায় খেয়ালই ছিল না, প্রায় নয়-দশ ঘন্টা এভাবেই কেটে গেছে। আপাতত খানিক স্বস্তি; এসময়ে একটু হালকা হওয়া, চোখে-মুখে একটু জল দেওয়া, একটু কিছু খাওয়া জরুরী বই কি! এইকথা মনে ভেবে, ওয়াশরুমের বেসিনের কাছে এলেন এবং আয়নায় নিজের মুখ দেখে চমকে উঠলেন গার্গী।
এমা! সারা কপাল যে সিঁদুরের লালে লাল! নিশ্চয়ই রঞ্জনা যখন একটু আগে ওঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন, তখনই লেগেছে। কী ঝামেলা!
পাশ থেকে টিসুপেপার নিয়ে মুছতে গিয়েও থমকে গেলেন। থাক না হয়, অনীশ আজ এমন অসুস্থ, এসময় তার মঙ্গল-অমঙ্গল!
নিজের কাছেই নিজেকে দুর্বোধ্য লাগল গার্গীর। অনীশের সঙ্গে স্বল্পকালীন বৈবাহিক জীবনে তিনি কখনও সিঁদুর পরেননি। পরতে পছন্দ করেননি বলেই পরেননি। পরিজনেরা কেউ জোরও করেননি। সেই তিনি আজ সিঁদুর মুছতে এত কুন্ঠিত! তাও কিনা যে সিঁদুর তাঁর নিজস্ব নয়, তাঁরই সপত্নীর সীমন্ত-সিঁদুর!
পাশের জানালা দিয়ে দেখতে পেলেন, ঘন অন্ধকার পেরিয়ে ঊষার জ্যোতি তাঁর কপালের মতোই পূর্ব-আকাশে মন্দাক্রান্তা লালিমা ছড়াচ্ছে। রাত উজিয়ে ভোর হচ্ছে। ‘তিমির কাটিবে গভীর আলোর রবে…’
তবে পঞ্চাশোত্তীর্ণ বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আসা গার্গীর বিগত রাত্রির অভিজ্ঞতায় মনে হল, জীবন বোধহয় এমনই দুর্বোধ্য, মানবমনের মতো। কখন যে কে কার সঙ্গে কী খেলার জালে জড়িয়ে পড়ে, কোনো হিসেব খাতায় তার অঙ্ক মেলে না।
এই যে গতকাল অনীশের অসুস্থতার খবর পেয়েই সব কাজ ফেলে ছুটে আসা, তার আপদকালে সব ছেড়ে অনীশের তাকে আগলে রাখা, এই যে তাদের দুটি নারীর নিজের নিজের মতো করে প্রিয়পুরুষের জন্য অঙ্গাঙ্গী রাত্রিজাগরণ, নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে জীবনের আত্মিক মূল্যায়ন, এই হয়তো জীবনসঞ্চয়।
বন্ধুত্ব,বন্ধুত্ব এবং বন্ধুত্ব। এই সম্পর্ক বন্ধনের উদ্যাপনে তার অন্তরতম সত্তায় অনুরণিত হতে লাগল, ‘চিরসখা হে…’
দুঃখ-সুখরহিত আনন্দ-অনুভবে ভেসে গেল চরাচর।
(গল্প)





Experienced responsive Team. They have been a great help to me and my company navigate the R&D tax claim process and have provided invaluable advice.
https://ausgrant.com has been a fantastic resource for my business. They are a trusted consultancy service specializing in government grants in Australia. AusGrant’s team worked closely with me, ensuring a smooth and successful funding application.
Entrepreneurs should not overlook the https://swansonreed.co.nz R&D tax incentive when planning innovative ventures. It provides tangible financial support for research-based activities. The New Zealand R&D tax incentive enhances innovation outcomes by reducing financial strain and enabling continuous development of products, services, and advanced technologies.
The innovation cafe R&D tax credit webinars are an excellent opportunity to understand innovation finance. The presenters’ knowledge and enthusiasm were inspiring. They offered valuable guidance on qualifying activities, documentation, and claim strategy. Every business engaged in R&D should take part to maximize available government incentives.
I’ve seen firsthand how taxtrex AI can transform business efficiency. By automating the collection and classification of R&D data, companies save valuable time and reduce stress during audits. R&D tax AI ensures maximum claim accuracy and compliance, helping finance professionals deliver better results with less effort.