বর্ষা অকৃত্রিম । শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায়
top of page

বর্ষা অকৃত্রিম । শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায়


 

(১)

দৌড়াতে দৌড়াতে কোনোরকমে নামখানা লোকালের শেষ বগিটায় উঠে পড়ে ফেলি। আর একটু হলেই মিস হয়ে যেত ট্রেনটা। পরের গাড়ি সেই আড়াইটেয়। ঝাড়া দেড় ঘন্টা বসে থাকতে হত স্টেশনে। আসলে সব দোষ যাদবপুর বাজারের ওই বাসনওয়ালার। এইটুকু একখানা টিনের ঝাঁঝরি, বলে কিনা চারশো টাকা! টাকা যেন নদীর জল, চাইলেই পাওয়া যায়! দরদাম করে চারশোকে আড়াইশোয় নামাতে লেগে গেল পাক্কা দশটি মিনিট। তাতেই ট্রেন ফেল হওয়ার যোগাড়।

গাড়িতে আজ একটু বেশিই ভিড়। পাদানিতে পা রাখা দায়। ফেলি তবু গুঁতোগুঁতি করেই ভিতর দিকে এগোতে থাকে। সে যাবে অনেকদূর। উঁকিলের হাট, নামখানার আগের স্টেশন। নয় নয় করেও আড়াই-তিন ঘন্টার পথ। গেটের মুখে দাঁড়িয়ে থাকলে তার চলবে না। ঝাঁঝরিখানা মাথার উপরে নিয়ে ভিড় ঠেলতে থাকে ফেলি। মনে ভাবে এত দরদাম করেও শেষমেশ হয়ত ঠকেই গেল, শেয়ালদায় কিনলে এটাই মিলত দু’শো টাকায়। পরক্ষণেই তার মনে হয়, ঠকলো তো ঠকলো। এ নিয়ে সে আর ভাববে না। দশদিন নয় পাঁচদিন নয়, একদিন আবদার করে মেয়েটা তার কাছে সামান্য একখানা ঝাঁঝরি চেয়েছে। সেটার দাম নিয়ে লাভক্ষতির অঙ্ক নাই বা কষল।


(২)

পরপর চারখানা মেয়ের পর আবার যখন মেয়েই জন্মালো, রাগ করে বাপ নাম রাখল ফেলি। এমন নাম রাখলে নাকি পরের সন্তানটি মেয়ে না হয়ে ছেলে হওয়ার সম্ভাবনা ষোলোআনা। নামের মাহাত্ম্যে ফেলির কোলে ভাই এসেছিল কিনা জানা নেই, তবে নিজের নাম নিয়ে ফেলির মনে একটা চাপা দুঃখ রয়েই গিয়েছিল। তাই জোয়ান বয়সে যখন পাশের গ্রামের বিশুর হাত ধরে বাড়ি ছাড়ল তখনই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল তার পেটে মেয়ে এলে আদর করে নাম রাখবে সোহাগি। বিশুকে সে কথা বলতে সে হেসে বলেছিল, ‘বেশ তাই হবে, পাগলি কোথাকার’!

সত্যি সত্যিই সোহাগি যখন পেটে এল বিশুর তখন দিন ফুরিয়ে এসেছে। সব কিছু ঠিকই ছিল। বিশু ছিল পাকা মাঝি। বড় ট্রলার নিয়ে মাছ ধরতে যেত সমুদ্রে। সাতদিন-দশদিন ভূতের মত খেটে তিন-চারদিনের জন্য বাড়ি ফিরত। ফেলি তার খোলার চালের ঘরে নিড়িবিলিতে সংসার করত। বিশু যে ক’দিন বাড়িতে থাকত জমিয়ে রাখত। কত মজা করত, কত গল্প বলত। সমুদ্রের কথা, দূরদেশের সব গল্পকথা। গল্প শুনে ফেলি মাঝেমধ্যে খিলখিল করে হেসে উঠত, কখনও বা লজ্জায় তার মুখটা লাল হয়ে যেত। হঠাতই একদিন রাতে খাওয়ার পর দাওয়ায় বসে দুজনে যখন গল্প করছে, বিশুর খুব কাশি শুরু হল। কাশতে কাশতে উঠে এল এক ঝলক তাজা রক্ত। কাকদ্বীপ হাসপাতালে নিয়ে যেতে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু বললেন ক্যানসার। ফুসফুসের ক্যানসারে মানুষ বেশিদিন বাঁচে না। বিশুও বাঁচেনি। শুকনো দড়ির মত দেহটাকে যখন পাড়ার লোকে শ্মশানে নিয়ে গেল আটমাসের পেট নিয়ে দুয়ারের এককোনে বসে সারারাত কেঁদেছিল ফেলি। ভালো থাকতে কতবার বলেছিল - খেওনা গো, সারাদিনে এত বিড়ি খেও না। বিশু বলত – ধুর পাগলি! বেটাছেলে, খেটে খাই, দুটো বিড়ি না খেলে গায়ে জোর পাই কোথা?

বিশুর হাত ধরে যেদিন বাড়ি থেকে পালিয়েছিল বাপের ঘরের সঙ্গে সম্পর্ক সেদিনই ঘুচে গিয়েছিল। আজ বিশুর হাতটুকুও হারিয়ে ফেলির আপনার বলতে আর কেউ রইল না। তবে বলতে নেই, ফেলির প্রতিবেশীরা মানুষ খারাপ না। ফেলির যখন ব্যথা উঠল তারাই দৌড়াদৌড়ি করল। সোহাগির জন্য একটু দুধ, দুটো কাঁথার যোগাড়ও তারাই করে দিল। তবে লোকের ভরসায় আর কদিনই বা চলে। সোহাগির ছ’মাস হতেই ফেলি কাজে নামল। মেয়েটাকে পাশের বাড়ির মীরাপিসির কাছে রেখে ভোরের ট্রেনে কলকাতা যাওয়া, দু-চার বাড়িতে রান্না করা, তারপর দুপুরের ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতে সেই বিকেল চারটে। বিশু থাকতে ফেলিকে বাইরের কাজের কথা ভাবতে হয়নি কোনোদিন। তাই শুরুর দিকে বেশ কষ্টই হয়েছিল। তারপর অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। আজ ফেলি চারটে বাড়িতে শুধু রান্না করে, সঙ্গে আরও তিনটে বাড়িতে ঘর মোছে, কাপড় কাচে। খাটনি বেড়েছে বাড়ুক, খাটছে বলেই না আজ দুটো পয়সার মুখ দেখছে সে। সবই তো মেয়েটার মুখ চেয়ে।

সোহাগিকে কোনোদিন বাপের অভাব বুঝতে দেয়নি ফেলি। সেই তার বাপ, সেই তার মা। বিকালে ফিরে মেয়েকে খাইয়েছে, আদর করেছে, ঘুমে চোখ জুড়ে এলেও সারা সন্ধ্যা ঘোড়া সেজে সোহাগিকে পিঠে নিয়ে হামা টেনেছে। বুকের রক্ত জল করে তিলে তিলে মেয়েকে মানুষ করছে ফেলি। সোহাগির এখন দশ বছর। ক্লাস ফাইভ। প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এখন সে কাকদ্বীপে হাইস্কুলে যায়। উঁচুক্লাসের একজন দিদিকে পাঁচশ টাকা মাইনে দিয়ে ঠিক করে দিয়েছে ফেলি, সে সপ্তাহে দু’দিন করে বাড়িতে এসে অঙ্ক আর ইংরাজিটা দেখিয়ে দিয়ে যায়। সে নিজে লেখাপড়া শেখেনি বলে কি মেয়েটাও মুখ্যু হয়েই থাকবে নাকি? সে লোকের বাড়ি কাজ করে বলে সোহাগিকেও তাই করতে হবে নাকি? মাস ছয় হল তার নামে ব্যাঙ্কে একটা বই খুলে দিয়েছে ফেলি। তিনটে বাড়ির কাজ বেড়েছে। মেয়েটা বড় হচ্ছে, তার একটা ভবিষ্যত আছে। মাসে মাসে সে এখন কিছু জমায়।


(৩)

ট্রেন জয়নগর ছাড়াতে ভিড় অনেকটাই হালকা হয়ে এসেছে। জানালার পাশে একটা সিট পেয়ে বসে পড়ে ফেলি। হুহু করে ছুটে আসা বাতাস লাগছে তার চোখে-মুখে। অবিন্যস্ত চুলগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে কপালের চারিপাশে। এলোমেলো কত কথা তার মনে ভেসে উঠতে থাকে। এই তো সেদিন, সন্ধ্যাবেলায় পড়তে পড়তে হঠাত উঠে এল সোহাগি। ফেলি তখন কাঠের জ্বালে ভাত চড়িয়েছে। পিছন থেকে এসে মাকে জাপটে ধরে একরত্তি মেয়ের সে কী পাকা পাকা কথা!

বলে কিনা – মা, তুমি একা একা এত খেটে মরো, কাল থেকে আমাকেও নিয়ে চলো না তোমার সাথে। আমার তো এখন স্কুলের ছুটি, তোমার হাতে হাতে সাহায্য করব।

নিজের হাত দিয়ে মেয়ের মুখটা চেপে ধরে ফেলি।

- ছি মা! তুই কেন কাজ করবি গো। আজ তোর বাপ বেঁচে থাকলে এ কথা বলতে পারতিস?

ফেলির গলা ধরে আসে। সোহাগি মুখ লুকোয় তার মায়ের বুকে। তারপর দীর্ঘ নৈঃশব্দ।

অনেকক্ষণ পর ফের কথা বলে সোহাগি।

- মা?

- বল, মা

- আসছে মাসে তো আমার জন্মদিন। আমায় একটা জিনিস দেবে গো?

- কী নিবি বল মা, নিশ্চয় দেব।

- দেখো না আষাঢ় শেষ হতে যায়, বৃষ্টির দেখা নেই। আমার দোপাটি চারাগুলো কেমন হলুদ হয়ে এসেছে। আমায় একটা ঝাঁঝরি কিনে দেবে? ওদের সকাল-বিকেল চান করাব।

সারাটা দিন ফেলিকে বাইরে বাইরেই থাকতে হয়। মেয়েটা স্কুল থেকে ফিরে কথা বলার সঙ্গী পায় না। তাই দাওয়ার সামনের একফালি মাটিটাতে মরসুমী ফুল লাগায় সোহাগি। ছোট ছোট অথচ নিপুণ দুটো হাতে যত্ন করে ফুটিয়ে তোলে বেল, জুঁই, দোপাটি, গাঁদা। ওরাই ওর সঙ্গী।

এ বছর এখনও যে কেন বর্ষা এল না কে জানে! মেয়েটা তাই একটা ঝাঁঝরির আবদার করেছে। সিটের নীচে রাখা টিনের ঝাঁঝরিটার দিকে একবার তাকায় ফেলি, তারপর দৃষ্টি ঘোরায় জানালার বাইরে। আজ যেন পথ ফুরোতেই চায় না। উঁকিলের হাট কখন যে আসবে!


(৪)

মায়ের হাতে ঝাঁঝরিখানা দেখেই আনন্দে ছুটে আসে সোহাগি। জড়িয়ে ধরে মাকে। তারপর কল থেকে জল ভরে এনে মনের আনন্দে দোপাটি চারাদের চান করাতে থাকে। দাওয়ার এক কোনে চুপ করে বসে দেখতে থাকে ফেলি। কেমন বৃষ্টির ধারার মত জল নেমে আসছে ঝাঁঝরির মুখ বেয়ে। দোপাটি চারারা কেমন মাথা দুলিয়ে চান করছে।

জল দিতে দিতে সোহাগি বলে – দেখো মা, এ বছর যে বর্ষা আসেনি সেটা আমি ওদের বুঝতেই দেব না। যেমন করে তুমি আমায় বাবার অভাব…

ফেলির চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে, গলার নীচটা ভারি হয়ে আসে। সোহাগির কথার শেষ শব্দগুলো সে আর শুনতে পায় না।

দোপাটির পাতাগুলো থেকে টুপটুপ করে জলের ফোঁটা পড়তে থাকে। ঠিক বৃষ্টির মত।

183 views0 comments
bottom of page