বুনোফুল । পার্থ প্রতিম দাস
top of page

বুনোফুল । পার্থ প্রতিম দাস


 

রাস্তার ধারে এদিক ওদিক কত ফুল। সাদা, লাল, হলুদ, বেগুনি। এসব ফুলের কেউ নাম জানে? আমি তো জানিই না। হাঁটছিলাম। বিকেল গড়িয়েছে। সূর্য পলায়নরত। কখন পালাবেন, কে জানে। প্রতিদিনই না জানিয়ে দুম করে হাওয়া দেয়। মিথিলা আসছে। সবসময় পাঁচ-দশ মিনিট লেট হয় ওর। এমন একটা জায়গায় থাকে যে তিন-তিনবার গাড়ি পাল্টাতে হয়। প্রথমে টোটো, তারপর ট্রেনে ছ-খানা স্টেশন পেরিয়ে বাস। বেচারি যখনই আসে চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। আজও তাই। টকটকে ফর্সা মুখখানা তপ্ত লালচে। টসটস করে ঘামের বিন্দু গড়িয়ে পড়ছে। যদিও আমি ওর প্রেমিক নই, তবুও ওকে আমার প্রেমিকা বলা যেতে পারে। আর যেকোনো প্রেমিকের পক্ষেই দৃশ্যটা বিড়ম্বনার। এই সময় আমার কী করা উচিত? নিজের রুমাল দিয়ে অমন রাজেন্দ্রানীর মতো মুখের ঘাম মুছিয়ে স্নিগ্ধ বিব্রত চোখদুটিতে চুমু খেয়ে শান্ত করা। এমন মুখের ঘাম মুছতে পারলে রুমালগুলোও বোধহয় ধন্য হয়। তবে আমি ওসবের কিছুই করলাম না। আসলে পারিই না। উল্টোদিকের রাস্তা দিয়ে আসছে পার্টি মিছিল। গলার শির ফুলিয়ে সে কী চিৎকার! 'প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি, খাসা তোর চ্যাঁচানি'। এই বিকেলবেলা কোথায় ঝোলা বারান্দায় ঠ্যাং তুলে সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে চা খাবে আর শারদীয়া দেশ পড়বে, তা না, দলবল নিয়ে ঘোড়ার ঘাস কাটতে বেরিয়ে পড়েছে। চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলছে। এরাও একসময়ে ক্ষমতায় ছিল, তখন আবার আরেকদল এরকম বেরোতো। এরা বউয়ের কাঁধ জড়িয়ে চায়ে চুমুক দিত। রাস্তা দিয়ে মিছিল যাচ্ছে, বিকেলের মুচমুচে আলো ভেঙে যাচ্ছে শ্লোগানে, আর ওদিকে ঘরে নীল আলোয় ভেঙেচুরে যাচ্ছে দুটো শরীর। আশ্চর্যের কিছু নেই। সবাই জানে। আমাদের সবারই অনেক দাবী। এই যেমন এখন মিথিলার কোমর জড়িয়ে হাঁটতে ইচ্ছা করছে। এটাকে তো একপ্রকার দাবীই বলা যায়। তবে সবার আগে ঘামটা মুছে দিতে হবে। প্রেমিকার ক্লান্ত মুখ দেখতে ভালো লাগে না।


অনেক কিছুই ইচ্ছা করে, কিন্তু প্রায় কিছুই পারি না। শরীর এগিয়ে গেলেও মন পিছন থেকে টেনে ধরে। রাস্তায় কাউকে মেয়েদের জামা ধরে টানতে দেখলে আমরা আকাশে উড়ন্ত সারস দেখতে দেখতে দ্রুত পার হয়ে যাই কিংবা ভরদুপুরে রাস্তার ধারের দেওয়ালে বুড়ো খোকাদের হিসু করতে দেখলে আলগোছে নাক টিপে অ্যাঁঃ অ্যাঁঃ করতে করতে পালাই। কিন্তু একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকা হাত ধরে হাঁটলে রে রে করে তেড়ে যাই। তখন আমাদের খুব লজ্জা লাগে। শেষমেষ একটা রুমাল এগিয়ে দিলাম। মিথিলা অবশ্য 'নো থ্যাংক্স' বলে নিজের রুমালটা বার করেই মুখ মুছতে লাগল। অমনি কথা বার্তা নেই জোরে হাওয়া বইতে লাগল, আর পথের ধারের সেই নানা রঙের ফুলগুলো জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে লাগল। একটু দূর থেকে দেখলে মনে হয় খলবলিয়ে হাসছে। যেন আমায় ঠাট্টা করছে তামাশা দেখে। সন্দীপ তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে বুকে টেনে নিয়ে মুখটা আলতো করে মুছিয়ে দিতে পারলে না? ভীরু, কাপুরুষ। কাপুরুষের প্রেম করার অধিকার নেই। তাদের জন্য বেঁচে থাকে দশ লাইনের কবিতা আর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। দূরে একটা বিভীষণ বাইকের পাশে দাঁড়ানো আমলকি রঙের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে মিথিলাকে দেখছে। ওকে মিথিলার পাশে ভালো মানাতো। ছেলেটা লম্বা বেশ, পেটানো শরীর, পরেছে একটা নীল টি শার্ট আর জিন্স, চোখদুটিতে বুদ্ধির ছাপ। তবু ব্যর্থ শিভ্যালরির দাপটে প্রথমে মনে হয় এগিয়ে গিয়ে চ্যালেঞ্জ করি। কিন্তু তারপরই ভাবি, মিথিলা আমার কে? আমি তাকে ভালোবাসলেও সে কি আমায় প্রেমিক ভাবে? কোনোদিন তো বলেনি, কোনো ইঙ্গিতও দেয় নি, আর মিথিলা তো দেখার মতোই মেয়ে, জনস্রোতে হেঁটে গেলেও বয়স নির্বিশেষে দৃষ্টি টেনে নেওয়ার ক্ষমতা আছে তার। অমন চোখ, ভ্রু বিভঙ্গ, মরালগ্রীবা, শরীরটা যেন রবিশংকরের সেতারের সুর। দৃপ্ত ভঙ্গিতে উজ্জ্বল চোখে যখন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, মনে হয় পা থেকে শুরু করে সমস্ত শরীর পাথর হয়ে যাচ্ছে। ক্রুশের গায়ে মাথায় কাঁটার মুকুট পরে হাত-পায়ে পেরেক পোঁতা মহামানব, মনে মনে বলি, হে ঈশ্বর, আমায় ক্ষমা করো। এমন একটা মেয়ে আমার মতো ছেলের সঙ্গে বন্ধু পাতালো? কেন? কেন? মেয়েদের মধ্যেই বুঝি নিগূঢ় সৃষ্টি রহস্য লুকিয়ে আছে।


মিথিলা হাঁটছে। পাশে হাঁটতে গিয়ে আমার আঙুল মিথিলার আঙুলে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে খুব ধরতে ইচ্ছা করছে ওর টুকটুকে আঙুলগুলো। মনে হচ্ছে হাতের মুঠোয় আমার-ওর আঙুলগুলো জড়াজড়ি করুক কিছুক্ষণ, আদর করুক। মাঝে মাঝে আমার আঙুলগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। সতৃষ্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু মিথিলার হাত ধরতে যেতেই সে ছিটকে গেল সামনে। রাস্তার ধারে নানান রঙের বাহারি বুনোফুলের মেলা। তারা কারোর তোয়াক্কা করে না, স্বাধীন। আমাদের দিকে তাকিয়ে যেন হাসির ফোয়ারা ছুটিয়েছে তারা। তিনটি সাদা বেগুনি ফুল ছিঁড়ে মিথিলা ফিরে এল।


এই নাও।


ফুল ছিড়লে আমার খুব রাগ হয়। ও জানে, তাই আরো বেশি বেশি রাস্তার পাশে এমন ফুল-টুল দেখলেই ছেঁড়ে। তবে কোনোদিন আমায় দেয় না। এটা নিয়ে আমার মনে মনে দারুণ অভিযোগ। সে কিছুক্ষণ তাদের দেখে, হাত বুলোয়, গালে ছোঁয়ায়, আমাকে দিয়ে গুচ্ছের ছবি তোলায় নানান ভঙ্গিতে। তারপর কোনো একটা বাড়ির পাঁচিলে গুঁজে আবার হাঁটতে থাকে। আমি প্রতিবারের মতো বিরক্ত স্বরে বললাম,


মিছিমিছি আবার ফুলগুলো ছিড়লে যে..


উফ, তোমার অত ভাবতে হবে না। ও ফুলের মালিক নেই। অনেক ফুটে আছে। তিনটে নিলে এমন কিছু ক্ষতি হবে না।


তাও ওরা সবাই একসঙ্গে ছিল। হাওয়া দিলে কেমন মাথা দোলাত সবাই মিলে।


গানও গাইত নিশ্চয়ই?


গাইতেই পারে। পৃথিবীর সব জীবের ভাষা কি আমরা জানি? অথচ সবার নিজস্ব ভাষা আছে, তারা কথা বলে, গান করে।


বেশ তো, তিনজন গায়ককেই তোমায় আজ উপহার দিলাম।


আজ একটা অন্য রকম দিন। কমলালেবুর মতো রঙ আকাশজুড়ে। সেই আলোতে দেখলাম ফুলগুলি চমৎকার। ঠিক যেন আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আমি আবার রাস্তার পাশে অবহেলায় ফুটে থাকা ফুলগুলোর দিকে তাকালাম। এত এত ফুল ফুটে আছে, তারা যে এইমাত্র তিনজন সঙ্গী হারিয়েছে তা বোঝার উপায় নেই। ওরা মনে হয় দুঃখ করতে শেখেনি, শোকতাপ ওদের শুষে নিতে পারেনি। নরম হাওয়া দিচ্ছে, আর তারা হেসে উঠছে। কী সুন্দর! পূবদিকে তাকাতেই দেখলাম গাঢ় আকাশে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। কিছু কিছু সময়ে সব কিছু ভালো লাগে, দুঃখ-মলিন যা কিছু সব উপেক্ষা করতে মন চায়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার আজ আমার হাতের মুঠোয়। বুক পকেটে ফুলের ছদ্মবেশে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম তিন গায়ককে রেখে দিলাম।


(সমাপ্ত)

 

অনুবাদক : পার্থ প্রতিম দাস

(ভয় সমগ্র- রাসকিন বন্ড)


5 views0 comments
bottom of page