কল্পবাস । দেবব্রত পাল
top of page

কল্পবাস । দেবব্রত পাল

Updated: Aug 10, 2022

এখন রুকাই নদীর ব্রিজের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে জটু।

তার বসার ভঙ্গিটি বড়ো চমৎকার রেলিংয়ের দু-পাশ দিয়ে পা দুটো ঝুলিয়ে দুই পা পেঁচিয়ে রেখেছে। আর গোটা শরীরটা যেন হাওয়ায় দোদুল্যমান। তার পরনে অতি জীর্ণ জিন্‌সের প্যান্ট আর ছেঁড়া গেঞ্জি। মাথার চুলগুলো কীর্তনীয়াদের মতো বড়ো বড়ো, তবে ভারি রুক্ষ। গালে লতিয়ে নামা দাড়ি। চোখে খেলনা সানগ্লাস। তার বাঁ-বগলে ধরা রয়েছে একটা আনন্দলহরী, বাউলরা যা ব্যবহার করে; গ্রামবাংলায় যাকে বলে ‘খমক’ বা ‘ঘোঙা’। সে আপন মনে ডান-হাতের ঝিনুকটা দিয়ে খমক বাজাচ্ছে আর মাঝে মাঝে হেসে উঠছে। কখনও বা খমক বাজানো ছেড়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে কী যে বলছে কে জানে। খমকের ঘুনঘুনাঘুন ছড়িয়ে পড়ছে রুকাইয়ের নীলচে জলে, নদীপাড়ের সাঁইবাবলা গাছের ডালে, উড়ন্ত পাখির ডানায়।


এখন মাঝ-মার্চের সকাল দশটা। ব্রিজের ওপর দিয়ে লোক চলাচলের বিরাম নেই। রুকাই নদীর দক্ষিণপাড়ে কল্পবাস গ্রাম, যাকে লোকে ছোটোকল্পবাস বা ছোটোকল্পা বলে জানে। আর উত্তর দিকে বাজারপাড়া, লোকের মুখে মুখে বড়োকল্পবাস বা বড়োকল্পা। এই বাজারপাড়াই কল্পবাস গ্রামে বেশ জমজমাট জায়গা। বাসস্ট্যান্ড, স্টেশন, স্কুল, হাসপাতাল সবই ওদিকে, তাই মানুষের চলাচলও বাজারপাড়ার দিকেই বেশি। বাস ধরতে, হাসপাতালে যেতে, স্কুলে পৌঁছাতে মানুষ তো গঞ্জের দিকে ছুটবেই। আর এখন, এই দশটার সময় তো যাকে বলে মার-মার সময়। সকলেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। জটুর অবশ্য অত তাড়াহুড়ো নেই। আপন মনে খমক বাজিয়ে চলেছে।


দেশ-গাঁয়ে সবসময়েই কিছু কর্মহীন মানুষ থাকে, তারা জটুর মতপ মানুষকেই খোঁজে- সময় কাটাবে বলে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে তেমনই একজন এগিয়ে এল- আরে জটুভাই, তুমি যে দেখি বাউলদের মতো খমক বাজাতে শুরু করলে। তা এটা পেলে কোথায়?

জটু খমক বাজাতে বাজাতেই গম্ভীর মুখে বলল, আমার বউ কিনে দিয়েছে।

লোকটা মজা পেয়ে বলল, তাই নাকি? বউ তাহলে তোমাকে খুব ভালোবাসে বলো?

জটু তার জটওলা চুল নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমাকে গতরাতে আচার দিয়ে রুটি দিয়েছিল।

যেন আচার দিয়ে রুটিটা ভালোবাসার অকাট্য প্রমাণ!


লোকটি এ কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ল। আশপাশে আরও জনাদুয়েক লোক মজা দেখতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তাদের একজন বলল, তোমার বউ রাতে কেবল আচার দিয়ে রুটি দিয়েছে? আর কিছু দেয়নি?


আরও কিছু? জটু যেন জটিল প্রশ্নের সামনে খেই হারিয়ে ফেলল। বলল, আর কী দেবে?


আর কী দেবে মানে? রাতে কত কী দেওয়ার থাকে! তোমার বউ যদি সবই বিলাস ঘোষকে বিলিয়ে দেয় তাহলে তুমি আর কী পাবা বলো?


পাশ থেকে অন্য জন বলল, এই থামো, আর নেমো না। লবঙ্গ শুনতে পেলে পিণ্ডি চটকে ছাড়বে!

লোকটা কোনো এক লবঙ্গের উদ্দেশ্যে একটা অশ্লীল খিস্তি মেরে বলল, আরে ছাড়ো তোমার লবঙ্গ! ওর পিণ্ডি কে চটকায় তার ঠিক নেই, ও কিনা আমার পিণ্ডি চটকাবে! যাকগে, চলো বাজারের বেলা হয়ে গেল। বলে বাজারের দিকে হাঁটা দিল। জটুকে ইশারায় বলে গেল, তাহলে জটুভাই, যা বললাম, আজ রাতে যেন শুধু রুটি আর আচারেই শেষ কোরো না!


জটু কী বুঝল সে-ই জানে, নিদারুণ পুলকে দ্বিগুণ বেগে খমক বাজাতে শুরু করল।

এই সময়ে ছোটোকল্পার দিক থেকে একটা মাঝারি মাপের মিছিলকে বাজারের দিকে আসতে দেখা গেল। আজ বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। শীত চলে গেছে বেশ কিছুদিন হল, তবু তার ঠান্ডা আমেজটা এখনও রয়ে গেছে। রোদের ঝাঁজটা ততটা নেই, আবার শরীরে শীতের জড়তাও নেই। এমন দিনে মিছিল-টিছিল বেশ জমে যায়। রঘুবাবুদের মিছিলটায় তাই বেশ দলে ভারি হয়েছে।


মিছিলটা কাছাকাছি আসতেই জটুর যেন আর আনন্দ বাঁধ মানল না। রেলিং থেকে লাফিয়ে নেমে সুড়ুৎ করে মিছিলের ভিড়ে মিশে গেল। তারপর জোরে জোরে খমক বাজাতে শুরু করল। মিছিলের যিনি কর্তা, অর্থাৎ রঘুবাবু, জটুকে অমন মিছিলে ভিড়ে যেতে দেখে বিরক্ত হওয়ার বদলে বিব্রতই বেশি হলেন। মিছিল থেকে যেসব স্লোগান উঠছে তা যদি জটুর মর্মে পৌঁছত তাহলে কিছুতেই মিছিলে জুটে যেত না। কথায় আছে, ‘যার নাই উত্তর-পুব, তার মনে সদাই সুখ’, এও হয়েছে তাই! তিনি আর কী করবেন, কেউ মিছিলে পা মেলালে তিনি তো আর গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারেন না, বিশেষ করে জটুর মতো একজনকে। তাতে তাঁরই বদনাম। তিনি তাই হাসিমুখেই মেনে নিলেন জটুর এই পাগলামী।


ব্রিজ পেরিয়ে শুরু হয়েছে বাজার। দোকানপাট, চা-গুমটি, সাইকেল সারানোর দোকান, চিকেন স্টল সবকিছু যেন একে অপরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। বস্তুত কোথায় যে ব্রিজের শেষ আর কোথায় বাজারের শুরু তা বোঝা মুশকিল। বাজারের এই অংশটার নাম নতুনপট্টি। নতুনপট্টির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় লবঙ্গর বাড়ি। বাড়ি বলতে অবশ্য আহামরি কিছু নয়। টালির ছাউনিওলা দাঁত-বের-করা ইটের গাঁথনির দুটি ঘর আর বারান্দা। বাড়ির গেটটা ক্যানেস্তারা টিনের। তার সামনে, মানে রাস্তার পাশটিতে একটা চা-গুমটি, লবঙ্গ এই গুমটিতে বসেই প্রতিদিন চা বিক্রি করে।

মিছিলটা ব্রিজ পেরিয়ে লবঙ্গর চা-গুমটির কাছাকাছি আসতেই কী হল, হঠাৎই স্লোগান-শাউটিং যেন চতুর্গুণ বেড়ে গেল। সব স্লোগানই চা-গুমটির বিরুদ্ধে। ভাবখানা এমন, যেন মিছিলওলারা পারলে চা-গুমটিটা এক্ষুনি ভেঙে দেয়। মিছিলের উত্তেজনার আঁচ জটুর মনেও লাগল নিশ্চয়। সেও চতুর্গুণ বেগে মাথা নেড়ে নেড়ে খমক বাজাতে থাকল, সেই সঙ্গে নাচ!


একসময় মিছিলটা নতুন পট্টি ছাড়িয়ে পুরোনো বাজারের দিকে বেঁকে গেল। সেখানে চার মাথার মোড়ে নেতাজী মূর্তির পাদদেশে যাবতীয় সভা-সমিতি বক্তৃতাবাজী হয়। জটু মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে চার মাথার মোড় পর্যন্ত গেল বটে কিন্তু পরক্ষণেই তার নজরে পড়ল একই রকমের আর একটা মিছিল উলটোদিক থেকে আসছে ছোটোকল্পার দিকে যাওয়ার জন্য। সে নিমেষে নতুন মিছিলটায় ভিড়ে গিয়ে একইরকম খমক বাজাতে থাকল। তারপর নতুনপট্টিতে এসে হাজির হল। এই মিছিলের লোকেদেরও যত হম্বিতম্বি ওই লবঙ্গর চা-গুমটিকে ঘিরেই। জটু একই রকমভাবে নাচতে থাকল। কেউ তাকে বাধা দিল না, বরং কেউ কেউ হেসে তাকে আরও নাচানাচি করতে উসকে দিতে থাকল।


মিছিলের কেউ না দেখতে পেলেও লবঙ্গ কিন্তু এতক্ষণ দুটো মিছিলকেই তীক্ষ্ণ নজরে রেখেছিল। ওদের নাচন-কোঁদন, তার চা-গুমটির বিরুদ্ধে স্লোগান— সবই সে মনে মনে গেঁথে রাখছিল। প্রথম মিছিলেই সে দেখেছিল এলাকার তাবৎ মানুষের কাছে তাকে হাস্যাস্পদ করে জটু তারই বিরুদ্ধে মিছিলে হাঁটছে। শুধু তা-ই নয়, খমক বাজিয়ে সকলকে আনন্দ প্রদান করছে। রাগে তার ব্রহ্মতালু জ্বলে যাচ্ছিল। ইচ্ছা হচ্ছিল চুলের গুছি ধরে টেনে নিয়ে এসে আচ্ছা করে দু-ঘা বসায়। কিন্তু নিজেকে সংযত রাখছিল। কারণ এখন হঠকারিতার সময় নয়। তার সময়টা মোটেও ভালো যাচ্ছে না। কিন্তু তার সংযম আর বাঁধ মানল না দ্বিতীয় মিছিলেও জটুকে নাচতে দেখে। ক্ষোভমত্তা ভৈরবীর মতো এলোচুল উড়িয়ে সে চা-গুমটি থেকে লাফ মেরে নেমে এল রাস্তায় তারপর জটুর চুল ধরে টেনে নিয়ে এল বাড়ির উঠোনে। বারান্দায় রাখা একটা মোটা লাঠি দিয়ে পাগলের মতো প্রহার করতে থাকল। জটুর চেহারা কিন্তু মোটেও রোগা-পাতলা নয়, সে যদি লাঠি কেড়ে নিয়ে প্রত্যাঘাত করে তাহলে লবঙ্গর পেরে ওঠা মুশকিল। কিন্তু সে ওসবের ধারই মাড়াল না। মার খেতে খেতে একসময় লুটিয়ে পড়ল উঠোনে।


নতুন পট্টির লোকজন স্তম্ভিত হয়ে দেখছিল লবঙ্গর কাণ্ড। কেউ কেউ মন্তব্য করছিল, আরে, মেয়েছেলেটা তো দেখছি জটুটাকে খুন করে ফেলবে! তোমরা কেউ যাও, ওকে বাধা দাও! কিন্তু কেউই সাহস করে এগিয়ে যেতে পারছিল না। কারণ নতুনপট্টির ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লবঙ্গর যাকে বলে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। লবঙ্গর যা দুর্বোধ্য প্রকৃতি, বলা যায় না হয় তো ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেই থানায় নালিশ ঠুকে এল!

লবঙ্গর দোকানের কর্মচারি পটকা অবশ্য এত বিস্মিত হয়নি। সে যখনই দেখেছিল জটুদা মদের ঠেক-বিরোধী মিছিলে হাঁটছে তখনই আন্দাজ করে নিয়েছিল আজ জটুর কপালে নিশ্চিত কষ্ট নাচছে। কারণ বৌদির হাতে জটুর এমন হেনস্থা মাঝে মাঝেই হয়। সে তাই বিভ্রান্ত না হয়ে কলপাড় থেকে জল নিয়ে এসে মাথায় ঢালতে থাকল। তারপর দোকান থেকে একটা কাচের গেলাসে খানিকটা বিলিতি মদ নিয়ে এসে জটুর মুখের সামনে ধরল। জটুও চোখ খুলে গেলাসটা দেখে চোঁ চোঁ করে মাল সাবাড় করে দিল।


***

জটুকে ঠিক উন্মাদ বলা চলে না। নিরীহ, শান্তশিষ্ট ধরনের ছেলে, আপন মনে থাকে। তার সঙ্গী খমকটা— ওটাকে নিয়েই নাড়াচাড়া করে, বাজায়। কখনও বসে থাকে ব্রিজের ওপরে, কখনও চলে যায় স্টেশনের উত্তর-কোণে নিবিড় ছায়াচ্ছন্ন ডোবাটার পাথরের ওপর, কখনও কিছুই নয় কেবলই হাসতে থাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে। আপনভোলা। যেন এই জটিল সংসারের যাবতীয় জটিলতাকে উড়িয়ে দিয়ে সদানন্দে আছে। কিম্বা কখন যেন মাঝ-আকাশে উড়তে থাকা লক্কা ঘুড়ির শিরদাঁড়াটা ছটকে গিয়ে নীল আকাশে দিশাহীনভাবে লাট খাচ্ছে!


বছর পাঁচেক আগেও কিন্তু জটু এমনটা ছিল না। তখন সে দিব্যি মানুষ। বাজারের এক টেরে বিঘা চারেক জমির ওপর আম-কাঁঠাল-আতা-পেয়ারা আর বাঁশ বাগানের ঘন ছায়ায় ঘেরা ছিল তার দু-কুটুরির মাটির দেওয়াল আর টালির ছাউনিওলা বাড়ি। মা নিস্তারিণী বুড়ি পরের বাড়ি ঝিগিরি করত, সেই সঙ্গে বাড়ির গাছ-পালা, গরু-ছাগলের দেখাশুনা। আর জটু ছিল অনেকটা ওই উড়ন্ত ঘুড়ির মতই। গোটা কল্পবাস জুড়ে ছিল ওর বিচরণ। কখনও মুনিষ খাটত, কখনও রুকাইয়ের জলে বিততি পেতে মাছ ধরত। উপকারী মানুষ হিসাবে সুনাম ছিল খুব। গ্রামের মানুষের সুবিধা-অসুবিধায়, হাসপাতালে যেতে কিম্বা শ্মশানযাত্রায়— জটুকে ডাকতে হত না। খবর পেলেই হাজির হতো। তাই বলে সে একেবারে অকর্মা ছিল বলা যায় না। শিল্পী প্রকৃতির মানুষ। বাউল গানের আসরে দোতারা বাজাত। আসর পিছু দেড়শো টাকা মজুরি। দোতারার হাত ছিল খুব সুন্দর, আশেপাশে বাউল গানের আসর বসলেই তার ডাক পড়ত।


তা এহেন ভালো ছেলের বিয়ের সম্বন্ধ আসতে দেরি হয় নাকি? যথাসময়ে গঙ্গাপাড়ের বিরিঞ্চি সর্দারের মেয়ে লবঙ্গর সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল। আর এই বিয়েটাই যেন হয়ে গেল তার কাল। বিয়ের জল শুকোনোর আগেই লেগে গেল খিটিমিটি। এ বাড়ির কোনো কিছুই যেন লবঙ্গর পছন্দ হয় না। তাদের আচার-বিচার, রীত-করণ সবকিছুতেই লবঙ্গর নাট সিঁটকায়। সেই সঙ্গে নিস্তারবুড়ির সঙ্গে অশ্লীল গালিগালাজ সহকারে ঝগড়া। জটুরা আদিবাসী, ঝগড়া কলহে কম পটু নয়, কিন্তু লবঙ্গলতার কলহনৈপুণ্যের কাছে নিস্তারবুড়ি ছেলেমানুষ!


জটু শুধিয়েছিল, কেন এমন করছ? এখানে তুমার কীসের অভাব?


লবঙ্গে তাচ্ছিল্যের গলায় বলেছিল, কীসের অভাব তা বোঝার ক্ষমতা যদি থাকত তাহলে তো আর কোনো দুঃখই থাকত না। বলি আমার কোন শখটা তুমি মেটাতে পেরেছ? দিনের শেষে চাট্টি পান্তা ভাত আর পরনে একফালি ছেঁড়া ন্যাকড়া— এতেই তো তুমাদের সব্বসিদ্ধি! কিন্তু আমি তেমনটা মানতে পারিনে! বলে একটু চুপ থেকে বলেছিল, তুমি একটা কুঁড়ে, অকম্মার ধাড়ি! রাতের পর রাত বাউলের আসরে মেয়েদের সন্নে ফস্টিনস্টি করো আর দিনের বেলা এর বাড়ি ওর বাড়ি বেগাড় খেটে মরো। আর তুমার মা সারাদিন কেবল উঠোনের আমপাতা-কাঁটালপাতা ঝাঁট দেয়। ওয়াক থু! এর নাম জীবন?


জটু এর উত্তরে বলতেই পারত, তুমার বাবা তো এই দেখেই বিয়ে দিয়েছিল। এখন কেন এসব প্রশ্ন তুলছ? কিন্তু জটুর এক স্বভাব, মুখের ওপর কিছু বলতে পারে না। সে বলেছিল, তাহলে কী করব বলো?


লবঙ্গ দাঁত খিঁচিয়ে বলেছিল, কী করবা তাও বলে দিতে হবে? বাউলগানের আসরে মেয়েদের সঙ্গে ছ্যাবলামি করার সময় তো দিব্যি মাথায় বুদ্ধি খেলে! ব্যবসা করতে পারো না?


ব্যবসা! জটুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল। ব্যবসা অতি গুরুতর বিষয়। অতি জটিল তার হিসাব-নিকাশ। অত কঠিন বিষয় তার মাথায় ঢুকবে কেন?


সে বলেছিল, কীসের ব্যবসা করব?


মদের ব্যবসা। পারবা?


মদের ব্যবসা! জটুর বিস্ময় যেন বেড়েই চলেছিল। মদ অতি উপাদেয় বস্তু। তাদের আদিবাসী সমাজে মদের খুব কদর। তাই বলে মদের ব্যবসা? সে তো দারুণ ঝকমারি ব্যাপার। পুলিশের ঝামেলা লেগেই থাকে। খুব পাটোয়ার লোক না হলে মদের ব্যবসা সামলানো মুশকিল। জটু বাউলের আসরে দোতারা বাজানো পাবলিক, মদের ব্যবসা সামলাবে কী করে? সে তাই নিরুত্তর চেয়ে রইল।


জটুকে অমন নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে লবঙ্গ আরও ক্রুদ্ধ হয়ে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছিল। সরো তো আমার ছামু থেকে। যত্তোসব নিক্কমা পুরুষ। পুরুষ তো নয়, ঢ্যামনা! তোমাকে আমার পুরুষ ভাবতেই ঘেন্না লাগে!


জটু ভেবে পায়নি এ কথার কী উত্তর দেওয়া উচিত। লবঙ্গের পছন্দের পুরুষ কেমন হওয়া উচিত তা তার বোধের বাইরে। লবঙ্গর ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেছিল উঠোনে। উঠে গায়ের ধুলো ঝেড়ে আবার এসে বসেছিল দাওয়ায়।


জটুর স্বভাবটাই এমন। প্রত্যাঘাত করাটা তার ধাতে নেই। কিন্তু তার মা নিস্তারবুড়ি অত সহজে মেনে নেওয়ার পাত্রী নয়। জটুর ওপর এত জুলুম তার সহ্য হয় না। পোষা ছাগলছানাটাকে কাঁঠালপাতা খাওয়াতে খাওয়াতে তড়পাতে থাকে, কী বললি রে হতচ্ছাড়ি মাগী? আমার ছেলে ঢ্যামনা? আইবুড়ো বয়সে কতগুলো নাং করেচিস যে আমার ছেলেকে আর মনে ধরে না? জিব ছিঁড়ে নুবো তোর!


এমনি করেই লেগে যেত চুলোচুলি। এমনকি হাতাহাতিও বেঁধে যেত। কিন্তু নিস্তারবুড়ি লবঙ্গর সঙ্গে পারবে কেন? একসময় রণে ভঙ্গ দিয়ে চলে আসত জটুর কাছটিতে। মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলত, তুই এত ভালোমানুষ হলি কেন রে জটু? এত নরম হলে কি ওই ডাইনির সঙ্গে ঘর করতে পারবি? আমি বুড়ো হইচি। কতদিন আর তোকে আগুলে রাকতে পারব? ওরে, আমি যে চিতেয় উঠেও তোর কথা ভেবে শান্তি পাব না। বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠত। লবঙ্গর সঙ্গে


নিস্তারবুড়ির প্রতিটি কলহের এমনটাই ছিল শেষ দৃশ্য।


একদিন কিন্তু কলহের শেষ দৃশ্যটা আর এমন রইল না। সেদিন ঝগড়া করতে করতে নিস্তারবুড়ির কী যে হল বুকে হাত দিয়ে উঠোনে বসে পড়ল, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়টুকুও দিল না। তবে গ্রামের লোক সেদিন একটা দৃশ্য দেখে ধন্যি ধন্যি করেছিল। তা হল শাশুড়ির শোকে লবঙ্গর কান্না। ওহো, সে কী কান্না! উঠোনে গড়াগড়ি দিয়ে আছড়ি পিছড়ি করে কান্না। লোকে অবশ্য তা দেখে মুচকি মুচকি হাসছিলও। উলটোদিকে জটু হয়ে গেছিল নির্বাক, পাথর।


বাস্তবিক, মা মারা যাওয়ার পর থেকে জটু নিদারুণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মাঝ-আকাশে উড়ন্ত ঘুড়ির শিরদাঁড়াটাই যেন ছটকে গেছিল। বুঝতে পেরেছিল এখন থেকে লবঙ্গর কথা মতোই তাকে চলতে হবে। অল্পে সন্তুষ্ট হওয়ার মেয়ে লবঙ্গ নয়। নিজের সুখভোগের জন্য যা যা করার প্রয়োজন সবই করবে এখন থেকে। ওকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। সে দেখতে পেয়েছিল মা মারা যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই লবঙ্গ বাড়ির পিছনের বাঁশবাগানে চুলাই মদের ভাঁটি খুলে ফেলল। শুধু তা-ই নয়, জুয়ার আসরও বসিয়ে দিল। মদ বানিয়ে বিভিন্ন ঠেকে পৌঁছে দেওয়া সেই সঙ্গে হপ্তার শেষ দিন সন্ধ্যায় বাড়ির পিছনের বাগানের আড়ালে জুয়ার আসর।


মদের গন্ধ, জুয়ারি আর মাতালদের হৈ-হল্লা সেই সঙ্গে অশ্লীল খিস্তি— বাড়ির পরিবেশ জটুর কাছে অসহ্য হয়ে গেছিল। যেদিন বাউলের আসর থাকত সেদিন তবু সে খানিকটা স্বস্তিতে থাকত, কিন্তু বাড়ি ফিরেই সেই নরকযন্ত্রণা! সে প্রতিবাদী মানুষ নয়, তবু এক-একদিন প্রতিবাদ করে বসত। তাতে তার ভাগ্যে জুটত কেবলই প্রহার নির্যাতন।


এ পর্যন্ত তবু ছিল ভালো। কিন্তু একদিন এমন দৃশ্যের সম্মুখীন সে হল, তার মনের ঘরে কেমন ওলোট পালোট হয়ে গেল। সেদিন বাউলের আসর থেকে মাঝ রাতে ঘরে ফিরে দেখতে পেল শোওয়ার ঘরে লবঙ্গকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে কে একজন। কে ওটা? নিশিকান্ত ঘোষের বখাটে, গাঁজাখোর ছেলে বিলাস নয়? দৃশ্যটা দেখে তার মাথায় যেন বিস্ফোরণ ঘটে গেল। কিন্তু আশ্চর্য তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরল না। গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে দোতারাটা বুকে জড়িয়ে ধরে ধপ করে পড়ে গেল দাওয়ায়।


তার পর থেকেই সে আবিষ্কার করেছে লোকে তাকে ‘জটু পাগলা’ বলে ডাকে।


(উপন্যাসের প্রথম অংশ)


'কল্পবাস' উপন্যাসটি খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হবে 'মণিকর্ণিকা প্রকাশনী' থেকে। কিছুটা অংশ থাকল 'পড়ার পাড়া'য়। বইটি চাইলে প্রিবুক করতে পারেন।


প্রিবুকিং লিঙ্ক : https://www.manikarnikaprakashani.com/kolpobash

bottom of page