আমোদি কলা । শম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়
top of page

আমোদি কলা । শম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়

Updated: Nov 8, 2021


 

(এক)


'একটা চিঠি লেইখ্যা দ্যা দেখি ভমরা, আমিই যাব চিঠি লিয়ে, ওই উপরআলা কত্তার কাছে। লাচনি বইল্যা কী মানুষ লই! মইলল্যা একটা কুকুরক্যাও এমন নাই করে...'


'হওঁ হওঁ দিব্য লেইখ্যে...'

বলে ভ্রমর সেখান থেকে চলে গেল গজগজ করতে করতে।

'তুমাকে গাঁয়ে থাইকতে দিছি এই কত লয়...'

নাচনিদের তো গ্রামে থাকতে দেওয়ার কথাই নয়, রীতি অনুযায়ী সমাজে অপাংক্তেয় ওরা।

বড় উরমার ইমলিদেবীর ঘটনা শুনে থেকে আমোদিনী বাগদি অস্থির হয়ে গেছে। আজকে খবর শুনেছে, গ্রামে থাকতে দেয়নি কেউ। গ্রামের একপ্রান্তে একটা ঝুপড়িতে থাকত। ওর রসিক কবেই ছেড়ে দিয়েছিল। যৌবন শেষ... নাচনির জীবনও শেষ তখন আর রসিক কোথায়? মরার পর গ্রামের লোক ছুঁয়েও দেখবে না। পায়ে দড়ি বেঁধে ফেলে দিয়েছিল পাহাড়ের কোলে। শকুন-চিল ছিঁড়ে খেলো। তাতেই ইমলিদেবীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত হল।

আমদি ভাবে, 'যখন গতর ছিল, আমার কলা উপভোগ কৈললি আর এখনে আমাকে চিল-শকুনে খাইল্যা আমার পাপ মিটব্যাক? কী পাপ কৈললিরে বাপ! গান শুনালি, লাচ দেখালি, তেখনে কত আদর আর আজ কুকুরের ল্যাও নীচ!'


আমোদি বাগদি এখন আমদি। বহুকষ্টে দিন পেরোয়। সংসার তো হল না।

আমদির সঙ্গে বিখ্যাত নাচনি পস্তুবালার জীবনের মিল কত! দেখেইতো ঠিক করেছিল নাচনি হবে।

সেইদিনই ঘরের সঙ্গে সব সম্পর্ক প্রায় শেষ হয়ে গেছিল।


(দুই)


স্কুলতো তখন বাগদিদের কাছে আকাশের চাঁদ। মুখুজ্যেদের গোয়াল ফেলত মা। সেকি যে সে গোয়াল। প্রায় পঞ্চাশটা গরু। পরিষ্কার করে গোবর নিয়ে ঘুঁটে দেওয়ার কাজটা ছিল আমোদির। ভালো লাগত না। মা কামিন, বাবা মুনিষ... সারা বছর খেটে দুই দুই চার মন ধান পেত। তবে দুপুরের মাড়-ভাত ওরাই দিত তাই চলে যেত দিন। লাগতই বা কত। মকরে একটা করে নতুন কাপড়। আর পেট ভরে মাড়ভাত।

আমদির কোনো চাহিদা ছিল না। তবে সন্ধ্যেবেলা যখন গুনগুন করে গান গাইত, বাপ সেটুকুও সহ্য করত না।


'আমদি ই সব কী বঠে! দালান-বাড়িতে থাকা লকগুলা ইসব সখ পুষে'

ভয়ে আর গাইত না।

কিন্তু কিছুতেই সহ্য করত না আমোদি। মন বিদ্রোহ করত। মনে মনে বলত একদিন ঠিক বহুলোক শুনবে আমার গান।

একটা আধবুড়ো দোজবরের সাথে আমোদির বিয়ে দিয়ে দিলো বাপ, ঘড়ি সাইকেল দিল, তবু এমন দোজবরে, তাও বুড়ো। তার চারটা ছেলেবউ সবাই আমোদির চেয়ে বয়সে বড়। মাও বারণ করেছিল। মুখুজ্যেদের কুটুমঘরের ভাগচাষী, তাই বাবা কারো কথাই শুনল না। বিয়ের এক বছরের মাথায় বিধবা হয়ে যখন ফিরে এল, উঠতে বসতে বাপ গঞ্জনা দিত। বুড়ার দু-হাল বলদ, চাষের জমি, নিজের মাথায় ছাদন সব আছে। 'তুই বিহা করা বউ বঠিন ন, ভাগ আছে তর ও উঠিনেই থাক গ'

আমোদি জেদ দেখিয়েছিল সেইদিন...

ওইসময় গানটা যেন ওকে ভেতর থেকে তাড়না দিচ্ছিল।

বাপ-মা ঘরে না থাকলেই গান গাইতে শুরু...


'রসিকা রসেতে ভাসে, ভ্রমর কমলে বসে...

নিরমল রসে ডুবি যায়…' শুনে শুনে শেখা...

তখন আসর বসত, হ্যাজাগের আলোতে, গ্রামের বাইরে পাথর চাটানে।


ছোটবেলায় গ্রামের শিবগাজনের দিন ছৌনাচ হত সারারাত। ভোরবেলা আসর ফাঁকা হলে হত নাচনি নাচ। তখন মেয়ে বউরা বেশি থাকত না, পুরুষদের ভিড়। আমদি ছোট ছিল। তাই কেউ কিছু বলত না। দেখত লোকে টাকা সেফটিপিন দিয়ে আটকে দিচ্ছে। বুঝত না পুরুষ গুলো সেই অছিলায় নাচনির শরীরে হাত দেওয়ার সুযোগ খোঁজে। বড় হয়ে বুঝেছে। গানগুলো অদ্ভুতভাবে শিখে নিত।

একবার পস্তুবালার নাচ আর গান শুনেই ঠিক করে ও নাচনি হবে।

'পাকা ডিংলার ভিতর করা

জুয়ান ছাঁড় ভাই পিরীতে ভরা

পিরীত করেলেরে খালভরা

আর পাবি না ঠান্ডা বড়তলা'


গলায় কী তেজ,কী সুর!

বিধবা হয়ে ফিরে আসার পর সারাদিন ঘরের মধ্যেই থাকত। ওই সময় আর মায়ের সঙ্গে ঘুঁটে দেওয়া গোবর ফেলার কাজ করতে যেত না।

একদিন তাজু ভূঁইয়া এই ভমরার বাপ, আমোদির বাল্য সহচর বুদ্ধি দিল

'নিজের মন যা বল্যা সেইটাই কর'

খুব তেজ ছিল বুদ্ধির। পড়ালিখাতেও খুব তেজ ছিল। তাজুই কত কথা বলত...

জয়দেব 'গীতগোবিন্দ' লিখেছেন, তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতী জয়দেবের গানের সঙ্গে নৃত্য করতেন বলে কথিত আছে, চর্যাপদ না কী যেন তাতেও যাঁরা পদ লিখতেন তাদের সাধনসঙ্গিনী ছিল, তাঁরাও নাচতেন। মনসামঙ্গলের জাত হয় তাতেই 'শুনিন নাই? বেহুলা সজ্ঞে জাঁইয়েও লাচ-গান কৈরয়েছিল।'

বাংলাদেশ নাচ-গানের দেশ। কলকাতার বাবুরা শখ করে বাইজি রাখত। বিহারের বড় সামন্ত রাজাদের নাচনি রাখা ছিল 'জলুসের' ব্যাপার।

'তুই গান বড়হ সুন্দর গাইশ, টুকু লাচটা শিখেলে আমদি।'

তাজুই একদিন নিয়ে এলো জগনরাম কে। বরাবাজার থানার লোক। জগন তখন ঝুমুরে ওস্তাদ। কিন্তু ঝুমুরিয়া হতে তখন তার সাধনসঙ্গিনী দরকার। স্ত্রী-পুত্র-মা-বাপ নিয়ে সংসার। ঝুমুরকে ভালোবেসে আমোদির সঙ্গে জুড়লো জীবনের তার। মাদল পাখোয়াজ সব বাজনাতেই ওস্তাদ। গায়কীতেও তুখোড় লোক। আমোদি ততদিনে জেনে গেছে নাচনি হলো 'ঝিঙ্গার ফুল'।

'সামে ফুইটব্যক্, সুভা ঝইরে জাব্যেক'

হোক না। জানত, কোনোদিন ঘর হবে না তার, রসিক দেখনদারী পিরীতের লোক, মনের মানুষ হলেও স্ত্রীর মর্যাদা কোনোদিন পাবেনা। তবু জগনলাল মাহাতোকে ভালোবেসে ফেলল। তার টাকাতেই জগনের সংসার চলত। জগনের বউ -এর আমোদিতে আপত্তি, আমোদির টাকাতে আপত্তি ছিল না। জগনও হয়তো অকালে না গেলে থাকতো সঙ্গে আমৃত্যু।

কিছুদিন বড় সুখ ছিল। একটা ছোট কুঁড়েঘরে তখন চাঁদের হাট। উঠোনে ছিল তুলসী মঞ্চ, মনসার থান। রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে রাঁধত সে আর জগন কথা আর সুর দিয়ে নতুন ঝুমুর বাঁধতো। পস্তুবালার কাছে কিছুদিন রেখে তাকে নাচ শিখিয়েছিল জগন। কোমর, পা, চোখ, ছাতির কাজগুলো শিখে আমোদি তাতে নিজস্ব ঠমক মিলিয়েছিল। লোকে নাম দিয়েছিল 'আমোদি কলা।'

কয়েকটা বছর তখন জগনের ঝুমুর আর নাচনি আমোদি বরাবাজার, রঘুনাথপুর-আড়শা- বান্দোয়ান-মানবাজার সব ব্লকে একেবারে জমজমাট। মাইকে সব পরব-মেলায় আমোদি আর জগনের গান। সেসব দিন কী সুখের ছিল! মা-বাপ সম্পর্ক ছেড়ে দিলেও আমোদি খেয়াল রাখত দূর থেকে। তাজুর হাত দিয়ে পাঠাত কিছু কিছু টাকা। তাজুই খবর এনেছিল বাপ-মা মরার।

তাজু আসতো মাঝে মাঝেই। ঝিঙ্গাফুলি সাঁঝবেলায় ছেলেটা যখন বাইদ্যের রাস্তা দিয়ে চলে যেত হেঁটে হেঁটে...

আমোদির বুকের ভেতর পাহাড় ভাঙত মনকেমনের। জগন বুঝত তাজুর নিরুচ্চার প্রেম... মনে মনে রাগ হত "টুকু রিষও ছিল"...

রাত্রে আমোদিকে ভুলিয়ে দিত শরীরী খেলায়... মেতে উঠত দুজনে।


(তিন)

সাম ঢলল, নাচনীর যৌবন গেল।

সিন্ধুবালা, পস্তুবালার মতো সবার কপালে সম্মান কোথায়? উনারা লালন পুরস্কার পেলেন।

বাকি কলাবতী, বিমলা, গীতারানী, রাজবালা, মালাবতী তাঁরা কোথায়!

আমোদিও জানত নাচনীর শেষবয়সে ভিক্ষাই গতি। গ্রামে কেউ থাকতে দিতে চায়নি। তাজু লড়েছিল ওর জন্য। তাজুর বউ লড়েছিল স্বামীর সঙ্গে। 'তুমার ছা বিয়াব আমি আর পিরীত কৈরব্যে নাচনীর সঙ্গে।'

বহু লড়াই করতে হয়েছিল মাতব্বরদের সঙ্গে। শেষপর্যন্ত একটা এনজি (NGO) দিদিমনির চেষ্টাতেই গাঁয়ে থাকতে পেরেছিল।

ইমলিদেবীর এমন মৃত্যুতে আবার ভয় পাচ্ছে আমদি। শেষপর্যন্ত কী যে গতি হবে। লোকশিল্পীর ভাতার জন্য নাম লেখানোর চেষ্টা করেছে বহুবার কিন্তু সেও পারেনি সবাই বলে 'করছি করবো।' কেউ করেনি কিছু। ভ্রমরটা ওর বাপের মতো নয়।

একটা নিঃসঙ্গ, অসহায় জীবনে আজও মনে পড়ে সারাদিন সংসারের কাজ শেষে সন্ধ্যেবেলা যখন সেজে উঠত , নৃত্যের চৌষট্টিকলায় মঞ্চে যেন ঘূর্ণি তৈরি করে দিত।

আমোদি জানেনা শিল্পের জন্য সারাটা জীবন দিলেও কেন শিল্পী হওয়া হল না, বরং অচ্ছুৎ হয়ে থাকতে হল। আর মৃত্যুও যদি ইমলির মতো হয়! বুক কেঁপে ওঠে... কাঠের আগুন জ্বলে ধিকি ধিকি, উনোনের পাশে বসে গুনগুন করে স্মৃতির ওমে মৃত্যুভয়কে ভুলতে চেষ্টা করে…


'এস নয়ন সলিলে ধুয়াইয়া দিই হৃদয়ে রাখিগো যতনে,

আমার হৃদি হতে কামবিষ যাক দূরে তব নখ মনির পরশনে...

তোর নামের ভিতর রয়েছে স্বরূপ দেখেছে জগৎ নয়নে।'


 

ছবি : ইন্টারনেট

73 views0 comments
bottom of page