top of page

রেলযাত্রী । শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়

Writer's picture: manikarnikapubmanikarnikapub

 

আজকেও ধড়ফড় করে উঠে বসল অভি। ঘুমটাকে কে যেন একটা পাতার মতো ছিঁড়ে দুভাগ করে দিল। না, অভির ঘুম সাদা পাতা নয়, লেখা ভরতি পাতা, তবে সে লেখা পড়া যায় না। অন্তত ও পারে না।

দূরে - একটা ট্রেন চলে যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে গেছে ট্রেনের ল্যাজখানা, যাওয়ার আগে যে হর্নটা দিয়েছিল সেটা লুটোনো আঁচলের মতো ঘষটে ঘষটে চলেছে - আর দু-এক সেকেন্ড, তারপরেই মিলিয়ে যাবে। ওই পড়ে থাকা আওয়াজ রোজ ওর ঘুমটা ভাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এই নিয়ে বাইশ দিন হল; শুরু হওয়ার হপ্তা খানেক পর থেকেই হিসেব রাখছে অভি।

বেডসাইড টেবল থেকে জলের বোতলটা নিল ও। ক্ষীণ আলো সামনের জানলা দিয়ে এসে ঢুকছে ঘরে। মেঝের ওপর সদ্য এসে পড়েছে, আবছা হয়ে ফুটে উঠেছে মেঝের টাইলস। বাতাসে জবা ফুলের গন্ধ পেল অভি। ভিজে জবা। কিন্তু এই সতেরো তলার ঘরে জবা ফুল আসবে কোত্থেকে?

খেয়াল হল, বোতলের ছিপিটা খুলেও জলটা খাওয়া হয়নি। দুঢোক খেয়ে পাশে তাকাল অভি। পর্ণা শুয়ে আছে। গায়ে চাদর জড়ানো। ওদিকে ফিরে আছে পর্ণা। হালকা নাক ডাকছে। এসির শব্দের ভেতর থেকে থেকেই ডুবে যাচ্ছে ওর নাক-ডাকা।

পর্ণা বিশ্বাস করে না ও নাক-ডাকে। বিশ্বাস করে না মাঝে মাঝে ওর হাঁটাটা খুব খারাপ দেখায়। বিশ্বাস করে না কখনও সখনও ওর ‘শ’-এর উচ্চারণটা ভুল হয়। পর্ণা নিজেকে নিঁখুত ভাবে। সারাদিন নানাভাবে নিজের খুঁতহীনতাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। প্রাকৃতিকভাবে যেখানে যেখানে খুঁত মনে হয়, সেগুলো ঢাকার প্রচেষ্টাতেই অনেকটা সময় ব্যয় করে। যেমন ওর ঠোঁট একটু সরু। স্তন ছোটো। ভুরু দুটো ঈষৎ হালকা। সব টেম্পোরারিলি মেরামত করে পর্ণা। রোজ।

নিঁখুত মানুষদের ভালোবাসা মুশকিল। অত মসৃণতায় ভালোবাসা গড়িয়ে যায়। অভি টের পায়, পর্ণার প্রতি আর ভালোবাসাটা নেই। তাহলে ওকে এই ট্রেনের গল্পটা বলত। যে ট্রেনটা যেতে যেতে ওকে জাগিয়ে দিয়ে যায়।

কিন্তু কেন জাগায়? কোথায়ই বা চলেছে সেই ট্রেন?

জোর নিশ্বাস টানল অভি। জবা ফুলের গন্ধ, কুয়াশার ঘ্রাণ, শিশির ভেজা ঘাসের গন্ধ।

আবার বড়ো নিশ্বাস নিল অভি। ভিজে ধুলোর গন্ধ। ক্লাসের বইপত্রের গন্ধ।

এইরকম একেবারে শেষরাতে শরীরটা জেগে ওঠে। বশে থাকে না। একরকম সুখ-পিয়াসী অস্বস্তি হয়। পরস্পর গন্ধগুলো পেতে পেতে অভির পুরুষাঙ্গ শিথিল হয়ে আসে। একটা রথ থেমে গেল যেন। অনেক দূর ছুটে ছুটে ঘোড়াগুলোর তেষ্টা পেয়েছে। অভির রক্তে এক নতুন আকুলতা। খাট থেকে নেমে পায়ে পায়ে জানলার কাছে যায় ও। নীচে কত ঘরবাড়ি। হিলিবিলি রাস্তা। কুয়াশার একটা স্তর নিশ্চেতনার মতো ভাসছে। ব্রাহ্মমুহূর্তে শহরটাকে বড়ো অসহায় দেখায়, যেন কুয়াশার মস্ত ডিম ফেটে সদ্য জন্ম নিচ্ছে, এখনও চোখ ফোটেনি, শক্তি নেই শরীরে।

স্টাডিরুমে চলে যায় অভি। সঙ্গে করে মোবাইলটা নিয়ে আসে। দরজা বন্ধ করে, সবকটা জানলা খুলে, চেয়ারে বসে। মোবাইলে মাকে ধরে।

মা খুব ভোরে ওঠে। তখনও গাছপালা জাগে না। মা স্নান সেরে পুজোর ফুল তোলে ঘুরে ঘুরে। ফোনে রিং হয়।

অভি?

মা। হ্যাঁ। আমি?

কী রে? উঠে পড়েছিস?

হ্যাঁ। ঘুম ভেঙে গেল।

শরীর ঠিক তো বাবা?

একদম ঠিক।

তাহলে ঘুম ভাঙবে কেন? তোর তো ডাকাত পড়লেও না ভাঙা ঘুম। চট করে পাকা ঘুমে চলে যেতিস তুই। রোজ টিভির ঘরে ঘুমিয়ে পড়তিস। তোর বাবা, নয়তো আমি কোলে করে বিছানায় তুলতাম। রোজ। কিছুতেই বিছানায় শুতিস না। যাক… আবার পুরোনো বাক্স খুলছি…

না মা বলো।

কী আর বলব বল দেখি… পর্ণা ভালো আছে তো?

ভালোই আছে। ঘুমোচ্ছে।

গেল-মাসে বললি বাইরে যাবি? সেসব হয়ে গেছে?

মা… সে তো আগের মাসেই গিয়েছিলাম… তার আগে তোমাকে বলেছিলাম… তাহলে… দুমাস আগে শেষ কথা হয়েছিল আমাদের…

হবে হয়তো। কত ব্যস্ত থাকিস। তা, ঘুমটা কি পাতলা হয়ে আসছে?

কী জানি… তবে

তবে কী বাবা? শোওয়ার আগে বালিশে একটু ‘ওং’ লিখে শুবি বাবা? আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে? তুই আবার বিজ্ঞানী মানুষ… এসব…

না মা। বলো। আমি করব। ভালো করে বলে দাও। বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলো।

কী হয়েছে অভি?

একটা ট্রেন চলে যাচ্ছে মা। রোজ একটা ট্রেন আমার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিয়ে কোথায় চলে যাচ্ছে, শুধু ওর হর্নের আওয়াজের ক্ষীণ রেশ…

কতদিন ধরে হচ্ছে এমন?

এই নিয়ে বাইশ দিন হল।

তুই গুনছিস?

হুঁ।

ট্রেনটাকে দেখতে পেয়েছিস?

না।

ওটা নীল রঙের ট্রেন। দূরপাল্লার।

কেমন করে জানলে?

ওই ট্রেনে চড়েই তো আমরা শেষবার বেড়াতে গিয়েছিলাম। দক্ষিণভারত গিয়েছিলাম সবাই মিলে। তোর বাবা, আমি, ছেলু, ঝরনা, তাতাই, সুজন মেসো, রাধা পিসি।

কিন্তু তাকে মনে রেখেছ কেন?

সে যে গত তেরো বছর আমাকে ডেকে তুলছে অভি। তুই চলে গেছিস, বলা হয়নি…

মা…

তোর বাবাও শুনতে পেত এই শব্দ। বছরখানেক শুনেছিল। তারপর সে তো অকালে…

বাবাও শুনত?

হ্যাঁ। রোজ ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে যেত। আমাকেও ডেকে দিত। আমরা চা নিয়ে বসতাম।

আমি পর্ণাকে ডাকিনি মা।

বুঝি।

ডাকতে ইচ্ছেই করেনি।

বুঝি।

ডাকতে পারছি না। ডেকে কোনো লাভ নেই। তুমি জানো, বাতাসে এখন জবার গন্ধ থইথই করছে। আলো দাঁড়িয়ে আছে আকাশে। আমার জন্য ভোর হওয়া থমকে আছে। মা, তুমি চা বসাবে?

পুজো হয়নি যে বাবা।

তা হোক। দু-কাপ বসাও। তোমার আর আমার।

আচ্ছা বেশ। বসাই তবে।

ফোন রেখো না। ফোন রেখো না। আমিও বসাচ্ছি।… এই যে দরজা খুলে কিচেনে গেলাম… কাপ ধুলাম। জল নিলাম। টিব্যাগ… একচামচ চিনি… মাইক্রোওয়েভ… এক মিনিট সতেরো সেকেন্ড… মা তুমি?

আমি তো গ্যাসে বসিয়েছি বাবা। দুদণ্ড দাঁড়া।

কেমন হয়েছে মা চা-টা?

ভালো হয়েছে।

একসঙ্গে খাই দুজনে। তুমি বড়ো কাপে নাও। দুজনের চা তো। আজ একটু বেশি করে খেয়ে নাও। ভাবো আমার সঙ্গে খাচ্ছ।

বেশ বাবা।

এইবারে ট্রেনের কথাটা বলো।

আমি শুনতে পেতে লাগলাম তোর বাবা চলে যাওয়ার বছর দেড়েক পর থেকে। সুহাসদাকে বললাম। সুহাস জেঠু রে, পুরোহিত।

বুঝেছি। বলো।

সুহাসদা শুনে বললেন, জপ করবে। ওই শব্দকে অন্য শব্দে বিলীন করে দেবে।… বছরখানেক আগে ঝরনা বলল ট্রেনের শব্দে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। এই হালে, তাতাইও…

তোমাদের সবার আমার মতোই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে!

হ্যাঁ অভি।

বলোনি কেন?

এই… বলা হয়নি আর… তুই ব্যস্ত থাকিস…

আর?

ছেলুর শুরু হয়েছে ঝরনারও আগে। ও-ও তো সেই তিন বছর বয়স থেকে আমাদের বাড়িতেই।

রাধা পিসি?

দিদির কি আর শব্দে ঘুম ভাঙার বয়স আছে বাবা? দিদি এমনিই ঘুমোয় না। রাত জেগে কখনও চোর তাড়াচ্ছে, কখনও বাপ-মায়ের সঙ্গে কথা বলছে, কখনও তোর বাবাকে বলছে ট্রেনে ভাস্কর-লবণ পেলে নিয়ে আসতে… তবে দিদিও শুনত একটা সময়। আস্তে আস্তে তো বুড়ি হয়ে গেল। এক্কেবারে বুড়ি।

আমরা সবাই তার মানে ট্রেনের শব্দ শুনছি মা। সব্বাই?

তাই তো মনে হয়…

তুমি কীভাবে শান্ত থাকছ এতদিন? কী জপ করছ?

আমি তো মন্ত্র-তন্ত্র জানি না। সুহাসদাকে বললাম। দাদা বলল, যাকে মন্ত্রের স্থান দিতে পারবে, তাকেই জপ করো।

তুমি কী বলো? আমিও বলব তবে, ঘুম ভাঙার পর…

আমি আমাদের সকলের নাম বলি যে বাবা… তোর বাবার নাম, আমার নাম, তোদের ভাইবোনেদের নাম, ছেলু, দিদি, সুজন দা… ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলি আর আস্তে আস্তে আলো ফোটে… ট্রেনটাকে দেখতে পাই… ছোট্ট একটা বিন্দুর মতো… গ্রাম-গ্রামান্ত-শহর-মফস্‌সল পার হয়ে চলে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে… দক্ষিণভারতের সমুদ্র… আমাদের দেশ পার হয়ে ও অগাধ জলের দিকে চলে যাবে… আমরা সবাই চলেছি ওর সঙ্গে…

 





35 views0 comments

Comments


1111-removebg-preview.png

গল্পের বই উপহার পেতে কে না চায়!
এখনই Subscribe  করুন,
আর পেয়ে যান আপনার প্রথম বইটির মূদ্রিত মূল্যের ওপর ২৫% ছাড় 

Thanks for being our family!

  • Youtube
  • pngwing.com
  • 1111
  • tumblr
  • Instagram LOGO PNG2

+91 8240333741

Magic Seeds Books LLP

119 Abhay Patuli Lane, Shuksanatantala, Chandannagar 712136

Email us at: manikarnika.pub@gmail.com

For any other queries feel free to reach us at: 8240333741(Call/Whatsapp)

©2022 by Manikarnika Prakashani.

bottom of page