নমো তস্স । কৌশিক সরকার | Manikarnika.Pub
top of page

নমো তস্স । কৌশিক সরকার

1.JPG

বিষয় : নন-ফিকশন্‌ (বুদ্ধ-জীবনকথা)
প্রচ্ছদ : ঋভু চৌধুরী

প্রকাশনা : মণিকর্ণিকা
মূল্য : ₹৩৫০
যোগাযোগ (কল ও হোয়াটস্অ্যাপ) : 8240333741






আগ্রহী পাঠকদের জন্য বইটির একটি অংশ এখানে দেওয়া হল।

Amazon Button PNG.png
Our Store Button PNG.png

              সম্পূর্ণ বর্ষাকাল ভগবান ঋষিপত্তনের যে কুটিরে কাটিয়েছিলেন তাকে ‘মূলগন্ধকূটিবিহার’ বলা হয়।                  বোধিলাভের পর থেকে তিনি আজীবন যেখানে যে যে কুটিরে অবস্থান করেছিলেন সেই সব                        কুটিরকেই ‘গন্ধকূটিবিহার’ বলা হয়। সম্ভবত ভিক্ষুগণ ভগবানের কুটিরে পুষ্প প্রদান করতেন এবং    সুগন্ধি দ্রব্য জ্বালতেন বলে এইরূপ নামকরণ হয়েছিল। আর ঋষিপত্তনের কুটিরে তিনি প্রথমবার অবস্থান করেছিলেন বলে হতে পারে তার নাম মূলগন্ধকূটিবিহার। এই কুটিরের ধ্বংসাবশেষ আজও বর্তমান সারনাথে বিদ্যমান।

         বারানসীতে যশ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন। এমনিতেই সম্পন্ন পরিবার নিয়ে আলোচনা হয়, তার উপর হঠাৎ সন্ন্যাস গ্রহণ সকলকে কৌতূহলী করে তুলল। দাসদাসীদের মাধ্যমে প্রায় প্রত্যেক গৃহে যশ ও তথাগতকে নিয়ে আলোচনা শুরু হল। বারানসীর মানুষের ধারণা হল যে, ঋষিপত্তনে কে এক শ্রমণ গৌতম এসেছে, সে কী এক জাদু করে যশকে বশীভূত করেছে। কিন্তু শ্রমণ গৌতমের অনেক জাদু তখনও বাকি ছিল। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই যশের প্রভূত পরিবর্তন দেখে তাঁর চার বন্ধু প্রবজ্জা গ্রহণ করে ভিক্ষুসংঘে যোগদান করলেন। বর্ষাকাল শেষ হবার আগেই যশ ও তাঁর চার বন্ধুর আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে থেকে আরও পঞ্চাশজন প্রবজ্জা গ্রহণ করলেন। সবমিলিয়ে ভিক্ষুসংঘে ভিক্ষুর সংখ্যা দাঁড়ালো ষাট। বারানসীবাসী এবার বলতে শুরু করলেন, শ্রমণ গৌতম সধবাদের তাদের স্বামী থাকা সত্ত্বেও বিধবা বানায়।

       বর্ষাকাল শেষের প্রাক্কালে একদিন ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ভগবান উপলব্ধি করলেন ধর্মের ব্যাপ্তি আরও বিস্তৃত করতে হবে। প্রবজ্জা গ্রহণকারী ভিক্ষুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্ন দিক থেকে ভিক্ষুগণ ধর্মের স্রোতে এসে মিলিত হচ্ছেন। অতএব এখন থেকে আমি শুধু একা প্রবজ্জা প্রদান করব না, বরঞ্চ আমি ভিক্ষুগণকে প্রবজ্জা প্রদানের অনুশাসন প্রদান করব। এখন থেকে ভিক্ষুগণ ভিন্ন ভিন্ন দিকে ভিন্ন ভিন্ন জনপদে চারিকা করবেন এবং মুক্তি অভিলাষী মানবকে সেই স্থানেই প্রবজ্জা প্রদান করবেন। ভগবান প্রবজ্জা গ্রহণের নিয়ম নীতিকে অতি সরলীকৃত করলেন। যিনি কর্মকাণ্ডে আস্থাবিহীন তাঁর পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। নিয়ম নির্ধারণ হল যিনি প্রবজ্জা গ্রহণ করবেন তিনি স্নান সম্পন্ন করার পর তাঁর মস্তক মুণ্ডিত করে তাকে তাৎক্ষণিক দুই খণ্ড চীবর (এক খণ্ড দেহের উপরিভাগের জন্য এবং অপরটি নিম্নাঙ্গের জন্য) এবং একটি ভিক্ষাপাত্র প্রদান করা হবে। তিনি সমবেত ভিক্ষুগণের সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসবেন এবং দুই হাত বুকের কাছে নিয়ে এসে করজোড়ে বলবেন-

                                          বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি

                                          ধম্মং শরণং গচ্ছামি

                                          সংঘং শরণং গচ্ছামি

      এইরূপ দ্বিতীয়বার এবং তৃতীয়বার ত্রিশরণ গ্রহণ করবেন। অতঃপর ধ্যান ভঙ্গ হলে ভগবান ভিক্ষুগণকে ডেকে বললেন-

চরথ ভিক্খবে চারিকং বহুজনহিতায়, বহুজন সুখায়, লোকানুকম্পায় অত্তায় হিতায় সুখায় দেবমনুস্ সানং।

   হে ভিক্ষুগণ! বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য, দেবতা ও মানুষের কল্যাণের জন্য তোমরা দিকে দিকে বিচরণ করো। তোমরা সদ্ধর্ম প্রচার করো, যার আদিতে কল্যণ, মধ্যে কল্যাণ এবং অন্তে কল্যাণ, যা অর্থযুক্ত, ব্যঞ্জনযুক্ত ও পরিপূর্ণ পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য প্রচার করো।

 

ভগবান বললেন, ‘আমিও বসে থাকব না, আমি আবার উরুবেলা অভিমুখে যাত্রা করব এবং কল্যাণকারী সদ্ধর্ম প্রচার করব।’

          এইভাবে বর্ষাকাল সম্পন্ন হবার পর ভিক্ষুগণ বিভিন্ন জনপদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন এবং তথাগত স্বয়ং আবারও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে উরুবেলা অভিমুখে যাত্রা শুরু করলেন।

          চলতে চলতে একদিন পথ প্রান্তে এক বৃক্ষের নীচে উপযুক্ত স্থান মনে করে ধ্যানমগ্ন হলেন ভগবান। কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর কিছু যুবকের ডাকে ভগবানের ধ্যান ভঙ্গ হল। তিনি চোখ মেলে তাকালে যুবকরা একযোগে উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞেস করল- হে শ্রমণ, আপনি কি এই পথ দিয়ে কোনো স্ত্রীলোককে যেতে দেখেছেন?

         ভগবান সর্বজ্ঞ, তবুও তিনি কৌতুক ও স্নেহার্দ্র কন্ঠে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন- ‘তোমরা নিজেকে না খুঁজে অপরকে খুঁজছ কেন?’

        একে তো এরকম সাংঘাতিক প্রশ্ন, তার ওপর সামনে এক শান্ত, সৌম্য সন্ন্যাসী, সব মিলিয়ে যে মানসিক প্রতিক্রিয়া হল তাতে যুবকেরা চোখ নামিয়ে বলল যে তারা এই জঙ্গলে প্রমোদভ্রমণে এসেছিল। সঙ্গে ছিলেন এক বারাঙ্গনা। গত রাত্রে প্রমত্ততার পর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সেই বারাঙ্গনা তাদের সমস্ত ধনরাশী ও দামি আভূষন নিয়ে পলায়ন করেছে। তাই তারা আজ সকাল থেকে সেই স্ত্রীলোককে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কয়েক মূহুর্ত নিশ্চুপ থেকে তথাগত উপদেশ দিলেন- যা গেছে তা অতীত, যাকে খুঁজছ তা ভবিষ্যৎ, পাবে কিনা জানো না, ভবিষ্যত অনিশ্চিত, অতীত দুঃখময়, তার জন্য বর্তমানকে নষ্ট করছ কেন?

 

বললেন, ‘তোমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে অতীত দুঃখময় কেন?’ অতীতে তো অনেক সুখস্মৃতি আছে। কিন্তু সেই সুখ আজ আর নেই বলে দুঃখের জন্ম হচ্ছে। ভবিষ্যৎ আশঙ্কাময় ও অনিশ্চিত। সুখ একমাত্র বর্তমানেই আছে। তাই বর্তমানে মনোনিবেশ করো। এতক্ষণ পর যুবকরা এই তেজোদীপ্ত শ্রমণের দিকে ভালো করে তাকাল। মনে হল সকালের নতুন সূর্যের প্রভায় শ্রমণ জোতির্ময় রূপ ধারণ করেছেন। তারা কি বুঝল কে জানে কিন্তু নিশ্চুপ হয়ে নতমস্তকে নমস্কার করে বিদায় গ্রহণ করল। তথাগত ডান-হাত তুলে চৈতন্য মুদ্রায় আশীর্বাদ করলেন।

        এটাই তথাগত বুদ্ধের বৈশিষ্ট্য। তিনি যখনই সুযোগ পেয়েছেন সৎ গুণ, সৎ চিন্তা, সদাচার, সদ্ধর্মের স্ফুলিঙ্গ জ্বালানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এ বিষয়ে এক বয়স্ক ব্যক্তির কাছ থেকে শোনা তাঁর জীবনের গল্প বলি। বহুদিন আগে তিনি তখন গ্রামের এক বাড়িতে মা, স্ত্রী, ছোট ছোট দুই সন্তান ও অবিবাহিত বোনকে নিয়ে বাস করতেন। একদিন প্রবল ঝড়বৃষ্টির রাত্রে প্রচণ্ড জোরে বজ্রপাত হল। তিনি বললেন আমার এই জীবনে এত জোরে বজ্রপাতের শব্দ আর শুনিনি। মনে হল বাজটা বাড়ির আশেপাশেই কোথাও পড়েছে। বৃষ্টি থামলে তিনি হাতে লন্ঠন নিয়ে বেরোলেন দেখতে যে বাজটা ঠিক কোথায় পড়েছে। দেখলেন গ্রামের আরও কিছু মানুষ বেরিয়েছে ওই একই উদ্দেশ্যে। কিন্তু না, অনেক খুঁজেও বজ্রপাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। এমনকি পরের দিন সকালেও অনেক খুঁজে কোনো চিহ্ন পেলেন না। মাস চারেক বাদে হঠাৎ একদিন উঠোনের নারকেল গাছটা ভেঙ্গে পড়ল। দেখলেন গাছটার ভেতরটা পুড়ে কালো ও ফোপড়া হয়ে গেছে। তখন বুঝতে পারলেন সেই রাত্রে বজ্রপাত এই গাছটার উপরেই হয়েছিল। ঠিক সেরকমই কোনো সিদ্ধ যোগী বা বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির সামনে দাঁড়ালে আমাদের ভেতরে ওই বাজ পড়ার মতো অজানা কিছু ঘটে। আমরা সেই মুহূর্তে কিছু না বুঝলেও অন্তর শুদ্ধিকরণের প্রক্রিয়া সেই মুহূর্ত থেকে শুরু হয়ে যায়। বহুসময় পরে হলেও একদিন না একদিন তাঁর চিত্ত পূর্ণ শুদ্ধ ও প্রজ্বলিত হয়ে আলোকরূপী অনন্তের সঙ্গে মিলিত হবেই।

Mandala Art 4.jpg
bottom of page