উত্তরে আছে মৌন । সৈকত ভট্টাচার্য | Manikarnika.Pub
top of page

উত্তরে আছে মৌন । সৈকত ভট্টাচার্য

Tibet%20Cover%20Final%20to%20send_edited.jpg

বিষয় : তিব্বতের ইতিহাসের গল্প

প্রচ্ছদ : দেবাশীষ দেব

মূল্য : ₹ ৩৫০

মণিকর্ণিকা প্রকাশনী

যোগাযোগ (কল ও হোয়াটসএ্যাপ) : 8240333741

Our Store Button PNG.png
Amazon Button PNG.png
আগ্রহী পাঠকদের জন্য বইটির প্রথম অধ্যায় এখানে দেওয়া হল।

বোদরাজ্যের রাজা

 

গরম লাগে তো তিব্বত গেলেই পারো! - বিরক্তিভরে কথাটা বলে পাশ ফিরল শুভ।

চেন্নাইয়ের গরমে ঘরে বসে সিদ্ধ হচ্ছি সবাই। এই এপ্রিল-মে মাস জুড়ে এখানে যে ‘অগ্নিনক্ষত্রম’ অর্থাৎ সূয্যিমামার চোখ-রাঙানি সহ্য করতে হয়, তার থেকে পরিত্রাণের উপায় ছিল আমাদের আপিস। সূয্যিদেবের ওয়ার্ম আপ করার মধ্যে আপিসের ঠান্ডায় সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ো, আর একেবারে অন্ধকার হয়ে ফুরফুর করে সমুদ্রের বাতাস বইতে যখন শুরু করবে তখন বের হও। এই পলিসি নিয়ে কটা বছর দিব্যি কাটল। এ-বছরটাও আলাদা কিছু হওয়ার কারণ ছিল না যদি না করোনার হামলাটা ঘটত।

লকডাউনের চক্করে সবাই ঘর-বন্দি। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরনো না-মঞ্জুর। ব্যাচেলর জীবনের বেসিক নিড - দুবেলার খাবার আর ল্যাপটপ - এসব তো মজুত আছেই। সবজিওলা আর অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যেকার একটা ছোটো দোকান ফ্ল্যাটের দরজায় নিত্যদিনের মাল সরবরাহ করছে। জ্বালা শুধু এই ‘গরমি’কে নিয়ে। বাড়িওয়ালা মিঃ সুধাকর ঘরে একখানা উইন্ডো এসি লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওভারটাইম খেটে খেটে দিন দুয়েক হল সে-যন্ত্রটি দেহ রেখেছেন। অভ্যেস না থাকলে যা হয়!

এই ওয়ান বি-এইচ-কে ফ্ল্যাটে আমরা তিনজনই বাঙালি। ঘরে তিনখানা সিঙ্গল-খাট, বাড়িওলাই পেতে দিয়েছেন। তার একটায় আমি, পাশেরটায় আমার কোম্পানির আইটিতুতো ভাইটি শুভ, আর অন্যটায় জয়দা। জয়দা আমার চেয়ে বছর চারেকের বড়ো। আপিসের কাজের বাইরে ওর একমাত্র এন্টারটেইনমেন্ট হল বই। বাকিসব ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে জয়দা কী করে জয় করেছে তা বাতলাতে গেলে ঢাউস উপন্যাস হয়ে যাবে!

বেলা খানিক গড়াতেই সেই অকৃতদার ইন্দ্রিয়বিজয়ী অপারজ্ঞানময় উঠে বসে হাতের বইটি বিছানার উপর রেখে পাশে খুলে রাখা স্যান্ডো গেঞ্জি দিয়ে কপাল মুছে যখন বলল, ‘বাপরে! কী গরম রে!’, তখনই সুযোগ বুঝে শুভর টিপ্পনি - গরম লাগে তো তিব্বত গেলেই পারো!

জয়দা এমনিতে মিতভাষী, ঘরে আছে না নেই সেটা মালুম হয় না। মোটামুটি বইপত্তরের পাতা, বাঁধাই, অক্ষয়, মায় সিলভার পোকাগুলোর সঙ্গেই ওর মান-অভিমান, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি চলে। কিন্তু একবার যদি ওর সাবজেক্টের মধ্যে কিছু পড়ে যায়, তাহলেই চিত্তির! সঙ্গে সঙ্গে সে-বিষয়ে ওর অর্জিত অঢেল জ্ঞানরাশির বর্ষণ শুরু হয়। বলা বাহুল্য, সেই বর্ষণে আমরা দেদার ভিজি, রীতিমতো সর্দিও লাগে!

যেইমাত্র শুভ তিব্বতের নাম নিল - আমি প্রমাদ গুনলাম। গত দুদিন ধরে জয়দা যে-বইটার সঙ্গে উঠছে-শুচ্ছে, মাঝেমধ্যে বাথরুমেও সহগমন করছে, সেটির প্রচ্ছদে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘Tibet’ কথাটা লক্ষ্য না করে উপায় নেই। শুভর দিকে কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক তাকিয়ে জয়দা বলল, খুব বুলি ফুটেছে দেখছি! তিব্বত সম্পর্কে কী জানিস শুনি?

দলাই লামা জানি, লাসা জানি, চমরীগাই জানি। - শুভর নির্লিপ্ত উত্তর।

যাও না! তিব্বতে গিয়ে মুখ ফসকে দলাই লামার নাম বলে দ্যাখো একবার, তারপর চীন কেমন দলাই-মলাই করে বুঝবে!

কেন? দলাই লামার কীসব প্যালেস-ট্যালেস আছে না?

সব এখন চীনের দখলে। দলাই লামা পালিয়ে এসে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। - বলে মুখে চুকচুক করে একটা শব্দ করে জয়দা আবার বলে, আজকের এই তিব্বত আর স্রোংচান গামপো, ঠিস্রোং দেচেনের তিব্বত! তিব্বতের বিশাল সাম্রাজ্যের বিস্তার চীনকে যে কতবার নাকানি-চোবানি খাইয়েছে তার ইয়ত্তা নেই! এসব গল্প জানিস?

শুভ ফটাফট মাথা নেড়ে সারেন্ডার করে দেয়।

এইসব ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ করে দেওয়াই ভালো। করা উচিত। কিছু তথ্য, কিছু গল্প জানা থাকলেও বলা উচিত অজানা। এই হার মানা কোনো মানুষ বা তার ব্যক্তিগত জ্ঞানের কাছে নয়, গল্পের কাছে। আবহমান কথকতার কাছে। একটা মানুষ যখন কোনো চেনা ইতিহাসই বলতে শুরু করে, তার বলায় এসে লাগে একেবারে নিজস্ব এক সুর, কত জানা ঘটনার অচিন ব্যাখা উঠে আসে বয়ানকালে, হয়তো কথকের অজান্তেই।

প্রথম যে-বাঙালি তিব্বত গেছিলেন তার নাম জানা আছে?

অতীশ দীপঙ্কর না? - আমি পাশ থেকে ফোড়ন কাটি।

আজ্ঞে না। তারও শ-দুয়েক বছর আগে গেছিলেন অতীশের মতোই এক গৃহত্যাগী রাজকুমার। মনে করা হয় তিনি অতীশেরই এক পূর্বপুরুষ। আচার্য শান্তরক্ষিত। প্রায় বাহান্ন বছর বয়সে পায়ে হেঁটে হিমালয় পার হয়ে লাসা পৌঁছেছিলেন।

কেন? বুড়ো বয়সে এমন শখ জাগল কেন? - শুভর প্রশ্ন।

টেনিদার স্টাইলে একটা হাইক্লাস হাসি হেসে জয়দা বলল, সেটা জানতে গেলে তার অনেক আগের অনেক গপ্পো জানতে হবে। প্রায় দুহাজার বছরের পুরোনো তিব্বতের গল্প। মানে ২০০ থেকে ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। ভারতবর্ষে তখন কে রাজত্ব করছে বল দেখি?

জয়দার প্রশ্নের সামনে আমাদের এক গাল মাছি!

বিস্তর ভেবে-টেবে শুভ বলল, হরিশচন্দ্র?

ভস্মাসুরের মতো দৃষ্টি হানল জয়দা। চাঁদি-ফাটা গরমটা দুম করে অসহনীয় হয়ে উঠল। ঘরের নৈঃশব্দ্য ভাঙতে আমি মিনমিন করে বললাম, মৌর্য্যরা?

এবার যেন একটু খুশিই হলেন মহাজ্ঞান। বললেন, কাছাকাছি। মৌর্য্যবংশের শেষ রাজা বৃহদ্রথকে হত্যা করে মগধের সিংহাসনে বসেছেন পুষ্যমিত্র শুঙ্গ। শুরু হয়েছে শুঙ্গ সাম্রাজ্যের। আমাদের গল্পের শুরুও সেই সময়...

‘শুঙ্গ’ শুনে কেমন একটা শুঁড়ওলা আরশোলা মনে হচ্ছে না? - আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকাল শুভ।

আহ! খালি বাজে কথা! - জয়দার গলায় একটা ছোটো হুংকার।

আচ্ছা আচ্ছা, কন্টিনিউ।

পুষ্যমিত্র ছিলেন বৃহদ্রথের সেনাপতি। বৃহদ্রথ বছর সাতেক রাজত্ব করেছিলেন। তারপর একদিন যখন মন দিয়ে মিলিটারির প্যারেড দেখছিলেন, সেনাপতি পুষ্যমিত্র এসে ঘচাং ফু করে দেয়।

এ কী! ঘচাং ফু করলেই হল? রাজার সিক্রেট সার্ভিস ছিল না? - শুভ উত্তেজিত।

কে জানে, ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু তারাও হয়তো পুষ্যমিত্রর পুষ্যি ছিল। এসব রাজা-গজার তো শত্রুর অভাব নেই! আসল কথা হল ক্ষমতার লোভ! পুষ্যমিত্র হলেন মগধের সিংহাসনে আসীন প্রথম ব্রাহ্মণ রাজা। ওদিকে মৌর্যরা ছিল বৌদ্ধ। ফলে বৌদ্ধরা এতদিন রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় নানারকম সুবিধা পেয়ে এসেছিল। এ ব্যাটা শুঙ্গ সিংহাসনে বসেই বৌদ্ধধর্মকে নির্মূল করে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘারাম-টংঘারাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করতে শুরু করে দেন... খোদ পাটলিপুত্রেই এক সংঘারামকে জ্বালিয়ে দিয়ে তার সব বৌদ্ধ সন্নাসীদের হত্যা করে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিলেন... আমরা আবার বখতিয়ার খিলজিকে খিস্তি করি! ছোঃ!

আচ্ছা, তিব্বতের রাজারাও তো বৌদ্ধ ছিলেন? তাহলে এখান থেকেই কি কেউ তিব্বতে গিয়ে… - প্রশ্ন করি আমি।

প্রথম প্রশ্নের উত্তর পার্শিয়ালি ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর ‘হয়তো হ্যাঁ’। জয়দা জবাব দেয়। ওর গলায় বেশ একটা ব্যাখ্যা আর গল্প-বলার আগ্রহ ফুটে উঠেছে।

মানে? মানে তিব্বতি রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা আরও অনেক পরে সেটা। তা ধর… হ্যাঁ, আরও ছ-সাতশো বছর পর তো হবেই। তার আগে হারগিজ নয়। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে ‘হয়তো’র কারণটা হল অন্তত সাতশো খ্রিস্টাব্দের আগে অবধি তিব্বতের লিখিত কোনো ইতিহাসই নেই।

কেন? কেন? - দুজনেই প্রায় হায় হায় করে উঠি।

শুধু ইতিহাস কেন, লিখিত কিছুই পাবি না। কেন বল তো?

আমরা খচখচিয়ে মাথা চুলকোচ্ছি, এমন সময় ওড়িয়া ঠাকুর রবি এসে ঢুকল। রবির ভালো নাম রবি দাস। আমরা ‘রবি ঠাকুর’ বলেই ডাকি। সে এসে দন্ত বিকশিত করে বলল, ভাইয়া, খানা লগা দিয়া।

শুভ মাথা চুলকোবার আগে গেঞ্জির তলায় হাত ঢুকিয়ে পেটও চুলকোচ্ছিল। খাবারের নাম শুনে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। আমারও যে খিদে পায়নি একেবারে তা নয়। শুধু জয়দাই অপার নিস্পৃহতার সঙ্গে বলল, কাল তো থোড় বড়ি খাড়া হয়েছিল, আজ কি খাড়া বড়ি থোড়?

রবি বালাসোরের লোক হওয়ায় বাংলাটা বুঝতে পারে, তবে ভালো কইতে পারে না। জয়দার প্রশ্ন শুনে বুক ফুলিয়ে শুঙ্গ-মার্কা মুখ করে বলল, কাতলা মাছের ঝোল!

ঘ্যাঁট আর ভাত খাওয়া মুখগুলো মাছের নাম শুনে প্রায় এক-বিঘৎ করে হাঁ হয়ে গেল!

এগুলো মাছের পিস? - ইঞ্চিখানেক লম্বা আর বোধহয় কয়েক মাইক্রন চওড়া একটা গাদা দুআঙুলে তুলে বলল শুভ।

চেন্নাইয়ের মাছওলাদের সমস্যা হল এরা এক্কেবারে মাছ কাটতে পারে না। বলা বাহুল্য আমার থালাতেও মাছের যে ছিটেফোঁটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি পড়েছে, সেগুলিকে দেখে যে কেটেছে তার প্রিসিশনের প্রতি সম্ভ্রম ব্যতীত আর কিছু মনে আসছিল না। জয়দার এসবে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই! ও দেখি থালাখানেক ভাত শুধু ওই দিয়েই সাপটে একটা আলু মুখে পুরে চোখ দুটো আধেক বুজে চিবোচ্ছে!

আমার প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু এখনও পাইনি। - সে অবস্থাতেই আলুটাকে সম্ভব গলায় চালান করে দিয়ে কথাটা বলল জয়দা।

এই এক সমস্যা লোকটার, কিছু একটা মুখ থেকে বেরুল তো জবাব না পেলে শান্তি নেই। দুহাজার বছর আগে তিব্বতে কেন মানুষ লেখাপড়া করেনি আমি কেমন করে জানব বলুন তো? আমাদের পাড়ার পিন্টুও একবর্ণ লিখতে জানে না - হরিতলায় চুল কাটে - কিন্তু কেন জানে না, তা কি কোনদিন ওকে জিজ্ঞেস করতে গেছি?

কী করে জানব? - বেজার মুখে বলি।

ভাব, ভাব। লক্ষণ সেনের মতো অমন সারেন্ডার করিস না। - বলে জয়দা মুখে একটা দিব্যভাব এনে বেসিনে গিয়ে ফুচুৎ ফুচুৎ করে কুলকুচি করতে লাগল।

আমি আর শুভ মুখ চাওয়াচায়ি করছি, জয়দা তোয়ালে দিয়ে মুখটা মুছে, ‘ঘ্রাউউৎ’ করে একটা পেল্লায় ঢেকুর তুলে বললেন, লেখার জন্য কী প্রয়োজন?

আমি বললাম, কালি।

শুভ উত্তর দিল, মানুষ।

জয়দা বলল, আরও বেসিকে যা। কী না হলে লেখা হবেই না? কালি ছাড়া পাথরে কুঁদেও লেখা যায়। আর মানুষ ছাড়া কি তোর মত উল্লুক এসে লিখবে?

পরক্ষণেই আমাদের বুদ্ধির উপর ভরসা ছেড়ে জয়দা নিজেই বলল, অক্ষর। লিপি। স্ক্রিপ্ট। অক্ষর না থাকলে লিখবে কী করে? তিব্বতি ভাষার কোন লিপি ছিল না। অনলি কথ্যভাষা। তাই শুধু ইতিহাস কেন, কিছুই লেখা হয়নি হাজার হাজার বছর ধরে। ফলে দেশটার ইতিহাস পুরো অন্ধকারে ঢাকা। পরে রাজা স্রোংচান গামপোর সময় লিপি তৈরি হয়। সে-গল্প যথাসময়ে বলব। কিন্তু তারপরেও যা ইতিহাস লেখা হয়েছে, সবই প্রায় ধর্মীয় ইতিহাস। তার মধ্যে ধর্মীয় উপকথা, গল্প-কাহিনি এত মিলেমিশে গেছে যে আসল ঘটনা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর!

লিপি কেমন করে তৈরি হয়? - প্রশ্ন করলাম আমি।

রহু ধৈর্যং। আগের কথা আগে বলি।

বেশ।

মুখে আনার দানা ফেলে চুষতে চুষতে আমরা আবার ঘরে ফিরে গল্পের লোভে গ্যাঁট হয়ে বসলাম ।

জয়দা পাশের বালিশটা কোলে টেনে নিয়ে গুছিয়ে বসে বলে চললেন, এদিকে পুষ্যমিত্র শুঙ্গ যখন কেলোর কীর্তি করে বেড়াচ্ছেন, তখন তিব্বতের প্রথম রাজা 'ঞাঠি চানপো'র আবির্ভাব।

আবির্ভাব? ভগবান নাকি? - হ্যা হ্যা করে খানিক হেসে নিল শুভ।

ইয়েস। ভগবান। অন্তত তিব্বতিরা সেরকমই ভেবেছিল। আসলে উনি তিব্বতি ছিলেন না। সম্ভবত উত্তরভারতের কোনও রাজ্য থেকে হিমালয় পার হয়ে তিব্বতে পৌঁছন। পায়ে হেঁটে।

পায়ে হেঁটে এভারেস্ট পার হয়ে গেল? তাহলে তো তেনজিঙের আগে… - শুভ হতঅবাক।

এভারেস্ট কেন পার হতে যাবে?

তাহলে? তিব্বত যাবে কী করে?

কেন? কলকেতা, ডায়মণ্ডহারবার, রানাঘাট, তিব্বত, ব্যস! সিধে রাস্তা, সওয়া ঘণ্টার পথ, গেলেই হল। - বলেই খ্যাঁকখ্যাঁকিয়ে একটু হেসে নিল জয়দা। ভাবখানা এই যে শুভর উপর ভালো শোধ নেওয়া গেছে। হাসি-টাসি শেষ হলে আবার গম্ভীরভাবে বলল, অনেক গিরিপথ আছে। তবে অত বছর আগে কীভাবে কোন পথে গেছিল এখন বলা যাবে না। হিমালয়ের মত নবীন পর্বত - রোজই ভাঙছে-গড়ছে। মনে নেই, সেই যে বলেছিলাম সেবার গোমুখে গিয়ে দুর্যোগে আটকে গেলাম, তারপর তো গোমুখ যাওয়ার রাস্তাটাই বদলে গেল। তাই দুহাজার বছর আগে সে ভদ্রলোক কোন রাস্তায় যে ওখানে গিয়ে পৌঁছেছিলেন তা এখন বলা মুশকিল। কিন্তু উনি গেছিলেন। কেন গেছিলেন - সে ব্যাপারে নানা মুনি নানা মত। অনেকে বলেন এখানকার কোনো রাজ্যের রাজা ছিলেন, শত্রুর হাত থেকে পালানোর জন্য রমণীর ছদ্মবেশে পাহাড় টপকে হাজির হন ওপারে। আবার অনেকে পুরাণের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছেন ইতিহাসকে। তারা বলেন উনি নাকি কোশলরাজ প্রসেনজিতের কোনো এক উত্তরসূরি, নাম ‘বুদ্ধশ্রী’। বিরোধীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য নারীর ছদ্মবেশ নিয়ে পালিয়েছিলেন। কেউ বলেন উনি ছিলেন কৌরবপক্ষের এক রাজা, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে লড়েছিলেন, শেষে পাণ্ডবরা জিতে যাওয়ায় তাদের হাত এড়ানোর জন্য একেবারে তিব্বত। মোদ্দা কথা হল, উনি যেই হোন না কেন, শত্রুর হাত থেকে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা বলে হাজির হয়েছিলেন হিমালয় টপকে সেই ‘বোদরাজ্যে’।

কী? বোদরাজ্য? সে আবার কী? এই যে বললে তিব্বত! - আমি নাক কুঁচকোলাম।

যাহা বাহান্ন, তাহা তিপ্পান্ন! আচ্ছা, চট করে একটা ক্যুইজ হয়ে যাক - ভারতবর্ষের আগে কী নাম ছিল?

শুভ তাড়াহুড়োয় ‘জম্বুদ্বীপ’ বলতে গিয়ে বলে ফেলল ‘জাম্বুবান’।

আমি খোঁচা দিয়ে বললাম, তোর না, ভারতবর্ষের নাম জিজ্ঞেস করেছে!

ও কেমন একটা হৃদি-ভাঙা দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এৎ তু ব্রুতে!

আহ! এত বাজে বকলে কি আর হিস্ট্রি চোখে দেখবার এনভায়রনমেন্ট তৈরি হয় রে! - গম্ভীর গলায় একটা মিনি হুঙ্কার ছেড়ে জয়দা বালিশের তলা থেকে একটা আধখাওয়া সিগারেট বের করে সেটা খুব কায়দার সাথে নাকের তলায় ঘষতে লাগল।

আমি বললাম, সিগারেটেও রেশন করছ?

হুঁ, লাইটার দিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে ঘরটাকে ধোঁয়াময় করে আমাদের কাশিয়ে টাশিয়ে একসা করে গুরুদেব বলল, রেশন না করলে আমার সিগারেটর সাপ্লাই কোথা থেকে আসবে শুনি? আন্না তো দোকানের ঝাঁপ ফেলে তিরুনালভেলি চলে গেছে।

বুঝলাম সমস্যা গভীর! কথা না বাড়িয়ে বলি, তারপর? ঞাট্রি কানকো কোথায় একটা পৌঁছল...

কানকো! তোর কানকো কেটে নেব! চানপো। ইংরিজিতে লিখলে হয় Tsanpo.

এ কী! সেটার উচ্চারণ তো… উচ্চারণ তো... - এইটুকু বলে জিভ দিয়ে টাকরায় কেমন একটা অদ্ভুত শব্দ বের করতে লাগল শুভ।

জয়দা সেটা দেখে হেসে বলল, হচ্ছে না তো? হবে না... ওটার উচ্চারণ চানপোই হয়। যেমন সিকিমে ছাঙ্গু লেকে গেছিস তো, অথবা পেমিয়াংচি গুম্ফা? বানানগুলো দেখেছিস? ‘Tsa’ দিয়েই লেখা হয়। আসলে এটা একটা তিব্বতি বর্ণ যার উচ্চারণ বাংলা 'চা' বা 'ছা'-এর কাছাকাছি। টেরি ওয়াইলি নামে এক মার্কিন তিব্বত-বিশেষজ্ঞ তিব্বতি হরফগুলিকে ইংরিজিতে ট্রান্সলিটেরেট করেন। সম্ভবত ১৯৫৯ সাল নাগাদ। এটাকে ওয়াইলি (Wylie) ট্রান্সলিটেরেশন বলা হয়। বুঝলি?

শুভ ঢক করে মাথা নেড়ে দিল। জয়দার সিগেরেটটা এত কথার ফাঁকে অর্ধেক থেকে এক চতুর্থাংশ হয়ে গেছে। আগুনটা ফিল্টারে ঢুকব ঢুকব করছে। জয়দা একটা যাকে বলে বুক ভরা টান দিয়ে ক্যারমের স্ট্রাইকারের মত জানলা দিয়ে ফিল্টারটা ফেলে দিল।

ও কী! কার মাথায় পড়বে ঠিক আছে? অমন করে ফেলতে বারণ করেছি না!¾হাঁ হাঁ করে উঠলাম আমি।

পড়বে না!—চোখ বন্ধ করে একগাল হেসে জয়দা বলল, ম্যাক্সিমাম আমাদের কার্নিশেই পড়ে আছে। দেখ। ইনিশিয়াল ভেলোসিটি, এঙ্গেল সব মেপে প্রোজেক্টেইলের অঙ্ক কষেই তো ছুঁড়ি যাতে ঠিক কার্নিশে ল্যান্ড করে! যাক গে... যেটা বলছিলাম... ‘বোদ’ - তিব্বতের প্রাচীন নাম। অনেকে ‘বোদ’ না বলে… যাক গে, সেটা আবার বাংলায় শুনলে নামের চেয়ে বেশি বদনাম মনে হবে। বাদ দে। ‘বোদ’ কথার অর্থ সম্ভবত ‘প্রাচীন ভূমি’ বা ‘আদি বাসস্থান’ জাতীয় কিছু। সেটা নিয়ে বিস্তারে পরে বলছি। এখন আমাদের রাজামশাই হিমালয় টপকে চলেছেন বোদরাজ্যে, আপাতত সেখানে ফিরে আসি। যদিও এসবই গল্পকথা, কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। প্রায় সাত-আটশো বছর পরে লিখিত ইতিহাস নির্ভর করে এসব ধারণা পাওয়া গেছে। সে-ইতিহাসও কতটা ভরসাযোগ্য—বলা মুশকিল।

কেন? - জিজ্ঞেস করি আমি।

কারণ - ধর্ম। পৃথিবীতে ইতিহাস যা লেখা হয়েছে তার অধিকাংশই রাজার অ্যাপয়েন্ট করা ঐতিহাসিকের লেখা। ফলে রাজনৈতিক কথা বেশি পাওয়া যায়। আর কিছু ইতিহাস লেখা হয় ধর্মের প্রভাবে। যেমন তিব্বতে লেখা হয়েছিল। বৌদ্ধধর্ম সেখানে প্রসারিত হওয়ার পর ইতিহাস লেখা শুরু হয়, আর লেখেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরাই। উভয়ক্ষেত্রে পক্ষপাত থাকলেও, রাজনৈতিক প্রভাবে হয়তো রাজার নামে প্রচুর ভালো ভালো কথা থাকতে পারে, কিন্তু উদ্ভট অতিমানবিক গল্পকথা থাকে কম, যেটা বিস্তর রয়েছে তিব্বতের ইতিহাসে। ফলে গল্প সরিয়ে সত্যি ঘটনাকে বুঝতে পারা একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। বুঝলি?

বুঝলাম। তাহলে ঞাঠি চানপোর সময়কাল বা এই ভারত থেকে আসার ঘটনা সত্যি নাও হতে পারে? - আমি শুধোলাম।

এমনকি ওইরকম কোনো লোকের অস্তিত্বই হয়তো ছিল না। তাও হতে পারে! ইনফ্যাক্ট বর্তমান পণ্ডিতদের মতে তিব্বতের প্রথম রাজা স্রোংচান গামপো সেভেন্থ সেঞ্চুরির। ঞাঠি চানপোর গল্প বানিয়েছেন বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা। আর দুজনের মধ্যেকার লম্বা সময়টাকে মেক আপ দিতে আরও বিশ-পঁচিশখানা রাজার নাম বিভিন্ন স্থানীয় প্রাচীন লোককথা থেকে তুলে স্রেফ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে - কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি ছাড়াই।

এ বাবা! এইভাবে ইতিহাস রচনা হয়েছে! এ তো পাতি ব্যাক ক্যালকুলেশন! - শুভ মন্তব্য করল!

একদম।

গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে জয়দা আবার শুরু করল -

হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম। এইসব জল মেশানো ইতিহাসের সত্যমিথ্যা বিচার করা খুবই মুশকিলের কাজ। অবিশ্যি সেসব কঠিন কর্ম পণ্ডিতেরা বিস্তর করেছেন। এখনও করে চলেছেন। এটা ওদের পড়াশোনার কাজের মধ্যেই পড়ে। কদিন আগেই এক টিবেটোলজিস্টের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ইমেলে। ভদ্রলোকের নাম স্যাম ভ্যান শাইক। ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টার থেকে তিব্বতি বৌদ্ধ সাহিত্য নিয়ে ডক্টরেট। জাতে ব্রিটিশ। বর্তমানে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতেই প্রোজেক্ট ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত।

স্যামের একটা রিসার্চ পেপার আমার হাতে আসে। একদম হালে প্রকাশিত। সেইটার কথা পরে বলব। আসলে, ওটা উলটে-পালটে দেখতে দেখতেই তিব্বতের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে বেশ আগ্রহ জন্মাল। ভদ্রলোক সদাশয় ব্যক্তি। মেইল করে কিছু জানতে চাইলেই ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে গুছিয়ে উত্তর চলে আসে। স্যামের যে-কাজটার কথা জেনে আমার এই উৎসাহ, সেটা আসবে আমাদের গোটা গল্পের শেষদিকে। এখন আপাতত ফেরা যাক রাজা রূপতির গল্পে।

এই রূপতি আবার কার পতি? এক্ষুনি তো অন্য একটা কার কথা হচ্ছিল! - শুভ আবার গল্পে মজ্জমান!

রাজা রূপতির কাহিনি পাওয়া যায় ‘দ্য রেড এন্যাল্‌স’ নামে একটি বইয়ে। কুঙ্গা দোরজে নামে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ১৩৪৬ থেকে ১৩৬৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এ-বইখানা লেখেন। ভদ্রলোক অবশ্য শেষবয়সে এসে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। তার আগে দীর্ঘদিন কাটিয়েছিলেন মোঙ্গল রাজপরিবারে। সেটা ইমপর্ট্যান্ট নয়, গুরুত্বপূর্ণ হল এই গ্রন্থকে বলা হয় তিব্বতের ইতিহাসের এক আকর গ্রন্থ। এর আগে যা লেখা হয়েছে, সেসব তেমন খুঁজে পাওয়া যায়নি। এটাই তিব্বতের বৌদ্ধ ইতিহাসের প্রাচীনতম গ্রন্থ যা বর্তমান ঐতিহাসিকদের হাতে এসেছে।

জয়দা একটা বালিশ টেনে নিয়ে কাত হয়ে আধশোয়া হল। এতক্ষণ বসে থেকে কোমর ধরে গেছে। আমিও হেলান দিয়ে বসলাম। জয়দা আবার বলতে লাগল -

এখানে বলছে রাজা রূপতি ছিলেন কৌরব পক্ষের এক রাজা। কৌরবদের সঙ্গে জুটেছিলেন নিজের আখের গোছাতে। যেই দেখেছেন কৌরবরা পাণ্ডবদের কাছে ব্যাপক ঝাড় খাচ্ছে অমনি কেটে পড়েছিলেন। য পলায়তি স জীবতি। উনি নারী ছদ্মবেশে পাণ্ডবদের হাত থেকে পালিয়ে হাজির হলেন হিমালয়ে। এটা গল্প নম্বর এক। গল্প নম্বর দুই - যেটা আগে বলছিলাম। কোশলরাজ প্রসেনজিতের এক বংশধরই হিমালয় পার হয়ে তিব্বতে পৌঁছেছিলেন। কোশলরাজ প্রসেনজিতের বংশধরকে প্রথম রাজা সাজানোর পেছনে আবার একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছেন অনেক ঐতিহাসিক। তারা বলছেন, যেহেতু কিছু শতাব্দী পরে এইসব ঘটনার কথা লিখে গেছেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরাই, তাই তারা যে নিজেদের ধর্মকে মহিমান্বিত করার চেষ্টাতে রত ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা প্রসেনজিত ছিলেন বুদ্ধদেবের একজন প্রিয় শিষ্য। মগধরাজ বিম্বিসারের শ্যালক। সাঁচি স্তূপের বিখ্যাত তোরণগুলির একটিতে বুদ্ধের সাথে প্রসেনজিতের সাক্ষাতের চিত্রও খোদিত আছে। সুতরাং বুঝতেই পারছিস - তার সঙ্গে তিব্বতি রাজবংশকে যুক্ত করে তার গৌরববৃদ্ধি করা এই কাহিনি নির্মাণের উদ্দেশ্য হওয়াটা আশ্চর্য নয়। গল্প তিন - প্রাচীন তিব্বতে যখন দৈত্য- দানো ঘুরে বেড়াত, সেই সময় বৎসরাজ

মৎসরাজ? মানে ইলিশ? - হঠাৎ যেন স্বপ্ন থেকে জাগরণ ঘটল শুভর!

হে ঈশ্বর! ওরে হতভাগা একটু ইতিহাস বইয়ের কথা মনে কর। খালি খাই খাই! ষোড়শ মহাজনপদের নাম মনে আছে?

শুভ মাথা নেড়ে দিল। মনে নেই। আমারও মনে নেই। দু একটা নাম মনে পড়ছিল। গান্ধার, কোশল... আর কীসব ছিল না?

কাকা কোথায়? কমল কুমার অন্য অন্য অনেকের চেয়ে বেশি শুনেছেন। মামার গায়ে পায়ে মস্ত মস্ত বিছে! - জয়দা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কী একটা বলল, আমাদের দুজনেরই শুনে মনে হল তিব্বতি ভাষা!

এটা কী জয়দা? - মাথা চুলকে জিজ্ঞেস করি।

ষোড়শ মহাজনপদ! প্রতিটা মহাজনপদের নামের শুরুর একটা করে বর্ণ দিয়ে লেখা ত্রিবাক্য। কাশী, কোশল, কম্বজ, কুরু, অঙ্গ - যার থেকে ‘বঙ্গ’ শব্দটির উৎপত্তি ধরা হয়, অস্মক, অবন্তী, চেদি, বৎস, শূরসেন, মল্ল, গান্ধার, পাঞ্চাল, মগধ, মৎস, বৃজি!

বাপরে! এতগুলো নাম মনে আছে?

হ্যাঁ। চেষ্টা করলেই থাকে। নিজেদের দেশের ইতিহাস ভুললে চলে? এই বলে একটা ইঞ্চি পাঁচেক লম্বা হাই তুলে জয়দা বলল, এই ষোড়শ মহাজনপদের একটা ছিল ‘বৎস’। অবিশ্যি মৎস্য নামেও একখানা ছিল, যদিও সেটা ইলিশ নয়। এনি ওয়েজ, এই বৎসরাজ উদয়নের এক পুত্র জন্মায়। রাজপুত্র জন্মালে দেশে আনন্দের জোয়ার বয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বইল না। কারণ যে জন্মাল সে এক বিকৃতদেহ মানুষ। চোখের পাতাগুলো নাকি নীচের দিকে আটকানো, উপরদিকে বন্ধ হয়। হাতের পায়ের আঙুল সব ব্যাঙের মতো - পাতলা মেমব্রেন দিয়ে জোড়া। এমন চেহারার ছেলে দেখে রাজা খুব ভয় পেয়ে আদেশ দিলেন - এই পুত্রকে নদীতে ভাসিয়ে দাও। কর্মচারীরা সেই আদেশ পালন করল। কিন্তু একটি দুধের শিশু, সে যতই বিকৃতদেহধারী হোক না কেন, তাকে অমনভাবে ভেসে যেতে দেখে এক কৃষকের মায়া হল। সে বাচ্চাটাকে নদী থেকে তুলে নিয়ে লালন-পালন করল। পরে বড়ো হলে এই সব ঘটনা জেনে সে মনের দুঃখে হিমালয়ে চলে যায়। তারপর একদিন হিমালয় পার হয়ে হাজির হয় সোজা তিব্বতে!

তারপর?

অচেনা একটা দেশ। মানুষজনের দেখা পাওয়া যায় না। দিগন্ত বিস্তৃত মালভূমি, পাহাড়। রুক্ষ শীতল জায়গা সব। ঘুরতে ঘুরতে চানথাং গোশি বলে একজায়গায় দেখা হয়ে গেল একদল মানুষের সঙ্গে। তারা ছিল বোন পুরোহিত।

কী পুরোহিত? - শুভর জিজ্ঞাসা।

বোন। তিব্বতের প্রাচীন ধর্ম।

ভাইও আছে নাকি? - নিমেষে বদবুদ্ধির পোকা কিলবিলিয়ে উঠল শুভর মাথায়।

জয়দা অবশ্য সেটাকে অত পাত্তা দিল না। বলল, বোন নিয়ে বিস্তারিত পরে বলছি। এটুকু শুনে রাখ যে বৌদ্ধধর্ম প্রবেশ করার আগে বোনই ছিল তিব্বতের জাতীয় ধর্ম। সেই ধর্মের কয়েকজন পুরোহিতের সঙ্গে মোলাকাৎ হল আমাদের রাজপুত্তুরের। তারা তো অমন অদ্ভুত গড়নের মানুষ দেখে অবাক। এ আবার কে! কোত্থেকে উদয় হল! তারা এসে স্থানীয় ভাষায় জিজ্ঞেস করল, কে তুমি? এ তো কিছুই বুঝল না। শেষে নাকি হাত তুলে আকাশের দিকে দেখিয়ে বোঝাল যে সে ঈশ্বর দ্বারা প্রেরিত হয়ে এখানে হাজির হয়েছে। যদিও আমার বিশ্বাস যে ওদের ভাষা না বুঝে কৃষক-পালিত রাজপুত্র হাত তুলে বোঝাতে চেয়েছিল যে সে সুদূর ভারতবর্ষ থেকে এসেছে। কিন্তু পুরোহিতেরা বুঝল উল্টো। অবিশ্যি তাতে ক্ষতি কিছু হল না! ঈশ্বর-প্রেরিত এই আশ্চর্যদর্শন মানুষকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল তারা। সবাই মিলে তাকে কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে চলল নিজেদের গ্রামে। সেখানে গিয়ে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়া হল যে এই দেবপুরুষ আমাদের রাজা। নাম হল ‘স্কন্ধবাহিত শক্তিধর’ যার তিব্বতি অনুবাদ ‘ঞাঠি চানপো’।

বাপরে! এত কিছু ডিটেইলে জানা গেল কী করে?

কিছুই জানা যায় নি। আট-ন’শো বছর পর সম্রাট রলপাচেনের সময় তিব্বতের ইতিহাস যখন প্রথম লিপিবদ্ধ করার কাজ শুরু হল তখন মুখে মুখে চলে আসা এইসব উপকথা স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসে।

তারপর কী হল?

তারপর নির্বিঘ্নে রাজত্ব চলতে লাগল। তিব্বতিরা নির্দ্বিধায় ঞাঠি চানপোকে তাদের প্রথম রাজা হিসাবে মেনে নিয়েছে। তার অবিশ্যি কারণ আছে। তিব্বত তখন একটা দেশ বা রাজ্য হিসাবে ছিল না। বারোখানা ছোটো রাজ্য ছড়িয়ে ছিল তিব্বত জুড়ে। তার মধ্যে একটি ছিল এই ইয়ারলুংদের। এদের বাস ছিল ইয়ারলুং উপত্যকায়। সে-উপত্যকার বুক চিরে বয়ে যেত ইয়ারলুং সাংপো নদী।

সাংপো, মানে, ব্রহ্মপুত্র? - আমি জিজ্ঞেস করি। ভূগোলে পড়েছিলাম মনে পড়ল।

তিব্বতি ভাষায় ‘সাংপো’ মানে নদী। যেমন শতদ্রুর তিব্বতি নাম ‘লাংকেন সাংপো’ বা সিন্ধুর নাম ‘সেংগে সাংপো।’ ব্রহ্মপুত্রর নাম ‘ইয়ার্লুং সাংপো’। আর এর অববাহিকাকে সেই জন্য ‘ইয়ার্লুং অববাহিকা’ বলা হয়। যাই হোক, এই ইয়ারলুং গোষ্ঠীর রাজারাই পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মকে তিব্বতে প্রসারিত করার উদ্যোগ নেন। আর বাকিদের থেকে শক্তিশালী হয়ে লাসা নগরীর প্রতিষ্ঠা করে জাঁকিয়ে বসেন। সেই জন্য এদের পূর্বসূরী হিসাবে ঞাঠি চানপো পেয়ে গেছেন প্রথম রাজার মর্যাদা। অনেকে বলেন ঞাঠি চানপোর আসল নাম, মানে ভারতবর্ষে থাকাকালীন নাম ছিল, ‘বুদ্ধশ্রী’। যদিও এসবের পরেও তিব্বতের ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত প্রথম সম্রাট স্রোংচান গামপো অবধি একটা কয়েকশো বছরের গ্যাপ।

তাহলে বৌদ্ধধর্মটা পৌঁছল কবে তিব্বতে?

ধৈর্য ধর। এ-উত্তর পেতে গেলে এখনও অনেক শতাব্দী পার হতে হবে।

শুভ অনেকক্ষণ ধরেই উশখুশ করছিল। গল্প শুনতে শুনতে বিকেল পার করে ফেলেছি খেয়ালই নেই। জয়দা একটু থামতে এবার ও বলেই ফেলল, বলছি তিব্বতিরা চা খায়?

হ্যাঁ! চা খায় কী রে! চা ওদের প্রায় স্টেপলের পর্যায়ে পড়ে! ঠান্ডায় জলের বদলে বারবার চা খাওয়াটাই ওরা প্রেফার করে বেশি। চমরীগাইয়ের দুধের থেকে তৈরি মাখন দেওয়া চা! - জয়দা চোখ বন্ধ করে চমরীগাইয়ের দুধের মাখনের ব্যাপারটা একটু অনুভব করবার চেষ্টা করল।

করুণমুখে শুভ বলল, তা চমরীগাই না হলেও আমরা একটু চেন্নাইগাইয়ের দুধের চা কি খাব না?

bottom of page