top of page

সুবাসিত বিষাদেরা গান গায় । শুচিশ্রী রায়

Subasito Bishadera Gaan Gaye - front - Final.tif.jpg

বিষয় : ব্যক্তিগত গদ্য

প্রচ্ছদ : গার্গী চৌধুরী

নামাঙ্কণ : শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়

মণিকর্ণিকা প্রকাশনী

মূল্য : ₹ ২২০

যোগাযোগ (Call or Whatsapp) : 8240333741

Amazon Button PNG.png
Our Store Button PNG.png
আগ্রহী পাঠকদের জন্য বইটির একটি অংশ এখানে দেওয়া হল।

হারানো দুপুরবেলার পটদীপ মুলতানি ভীমপলাশিরা

 

শীত আর গরমের লম্বা ছুটির দিনগুলোর কথা ভেবে মনকেমন করে। আমাদের দোতলা বাড়ির একতলার বড়ো ঘর যেটা কিনা আমার আঁকা শেখার, অঙ্ক কষার, আর পরের দিকে রেওয়াজের জন্য নির্দিষ্ট ছিল, তার গা লাগোয়া লম্বা বারান্দার পরে হাত দশ চলন রাস্তার গায়েই বাড়ির পাঁচিল। পাঁচিলে ঠেসান দিয়ে একটা লম্বা ক্রোটন গাছ, ফুরুস ফুলের গাছ, আর ডবল টগরের গাছ। বারান্দার সীমানায় দুহাত উঁচু ইটের দেয়াল শুরু থেকে শেষ অবধি। রাস্তায় এসে গাছের আড়াল থেকে মুন্না ডাক দিত নরম গলায় ‘বৈকালি, এই বৈকালি’। ও একাই কেবল এই নামে চিনত আমায়। বিকেলে জন্মেছিলাম তাই জেঠু নাম রেখেছিলেন ‘বৈকালি’। সময়ের সঙ্গেসঙ্গে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের জটিলতায় আমার খুব পছন্দের সে নাম হারিয়েই গেছে আজ। মুন্নাদের বাড়ি আমার বাড়ির বাঁ-হাত ধরে এগিয়ে গিয়ে দুটো বাড়ির পরে ডানদিকে মানে ইংরেজি এল এর মত গেলে তার শেষপ্রান্তে। ও কলকাতায় মনোহরপুকুরে মামাবড়িতে থেকে পড়াশুনো করত আর তাই ইস্কুলের ছুটিগুলোতে সুযোগ পেত মা বাবা ভাই এর সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাবার; আর হ্যাঁ আমাকে বড্ড ভালোবাসত। গায়ের রং কালো বলে মুন্নাকে নানাজনের কাছে নানান কথা শুনতে হত তাই মনের মধ্যে অনেক কষ্ট। ওর মিষ্টি ঠাণ্ডা স্বভাব, চিকণ মুখ আর মা কালির মতো ঢেউ খেলানো একপিঠ চুল সব আমার খুব পছন্দের ছিল। আমার মাথায় বরাবর ফুরফুরে কিন্তু বিশ্বস্ত কয়েক গাছি, বিশ্বস্ত কারণ এতদিনেও তারা আমাকে ছেড়ে যায়নি! মুন্নাকে জানালার ধারে বসিয়ে আমি রিয়েল স্টাডি করতাম। খুঁজে দেখলে সেই আঁকার খাতা এখনও পাওয়া যেতে পারে। দুপুর যেই হেলান দিত বিকেলের গায়ে মানে এই তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ মুন্নার গলার হাতছানিতে আমি ঘরের দরজা খুলে বারান্দার পাঁচিলে এক পা তারপর শূন্যে এক লাফ দিয়ে বড়ো পাঁচিলে অন্য পা ছুঁয়েই জোড়া পায়ে ইট বাধানো রাস্তার ওপর লম্ফ দিয়ে পড়ে ‘চল’ বলে দৌড় লাগাতাম ব্যাঙার বাগানের দিকে। নিপাট ভালো শান্ত মেয়েটা আমার মতোত ডানপিটের পিছু পিছু ছুটে হাঁপিয়ে একশা হত।

        ব্যাঙার বাগানে বিরাট বিরাট লিচু গাছে টিনের খালি ক্যানেস্তারার ভেতর ইটের ছোটো টুকরো ভরে লম্বা দড়ি দিয়ে টাঙানো থাকতো। ভাম বা হনুমানের আনাগোনা হলেই মাটিতে চাটাই বিছিয়ে শুয়ে থাকা পাহারাদার দড়িতে টান দিয়ে বেজায় বিশ্রী ঢং ঢং শব্দ করতো যাতে ওরা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। মাঝরাতে বিছানায় শুয়ে বহুদিন ওই কদাকার শব্দ কানে এসেছে। এত গাঢ় ঘন গাছপালা ঘেরা সেই বাগান যে রোদ্দুর আসত ছেঁড়া ছেঁড়া আর গাছপালার মাঝখানে ছোট্ট একটু গোলাকার ঘাস ওঠা ন্যাড়া জমিতে আমরা ছুটোছুটি সেরে নিতাম, তারপর ফলসা গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে তেঁতুল খেতাম। গাছের গোড়ায় ঊর্ধ্বমুখী তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত মুন্না, ‘বৈকালি আমাকে উঠিয়ে দিবি রে’? সঙ্গী পাড়াতুতো দাদাদের কেউ কেউ দয়াপরবশ হয়ে ওকেও উঠিয়ে নিত গাছে। আমার দুই পা ফলসা গাছের ডালের দুদিকে দুলতে থাকতো আর তার ছায়া দেখা যেত নীচের ডোবায়। এখন সেই ছায়াও নেই আর ডোবাও নেই আছে কেবল আমার এই ডুবুরি সত্তা। যতক্ষণ শ্বাস জমিয়ে রাখতে পারি কখনও সেই জলে কখনও সেই জঙ্গলে ঘুরি ফিরি, বেঁচে থাকি। গা এলানো বিকেলগুলো হাততালি দেয় লম্বা নারকেল গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে যার গোড়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিল ফ্যালন। পাড়ার মানুষকে অতীষ্ঠ করে রেখেছিল তার চুরি বিদ্যার মহার্ঘ্যে। আহা বেচারা ডাব চুরি করে ঘুমিয়ে গেছিল আর পাড়ার ছেলেরা ধরে কী মারই না মারল! কোনো এক বড়োসড়ো চুরির পরে মার খেয়ে মরেই গেল ফ্যালন। কালোকোলো আঁটসাঁট চেহারা তার দিব্য মনে আছে আমার। আজ এই বয়েসের বিকেলগুলো একঘেয়ে আর মনমরা। গোধূলির সেই মায়াময় আলো আর নেই। চাল-ধোয়া ঘোলা রঙের আকাশে দুপুর কখন পিছলে গিয়ে বিকেলের বাস্তুতে হাজির হয় জানতেও পারিনা। একরাশ হারিয়ে ফেলা দুপুর ভীমপলাশির মত অভিমানী আর মরমিয়া। মরমিয়া, শঙ্খর খুকির নাম, ভারি মোলায়েম।

        ভীমপলাশির সুরে অনেক ভজন বাঁধা হয়েছে, এমনকি ভীমপলাশি রাগের উপস্থাপনাতেও ভক্তি ভাবই মুখ্য - অন্তত আমি যেটুকু শুনেছি বা শিখেছি তা দিয়ে বলতে পারি। আমি ভক্তি আলাদা করে বুঝি না মানে অনেকটা ‘তন্ত্র-মন্ত্র জানি নে মা’ গোছের। আমি বুঝি প্রেম, ভালোবাসা, আর অন্তরের সম্পূর্ণ সমর্পণ। ভালোবাসার সঙ্গে শ্রদ্ধাবোধ জড়িয়ে থাকে, ভয় কেন থাকবে? থাকবে সম্ভ্রম কারণ আমি এই বিশ্বাসেই থাকতে ভালোবাসি যে তিনি মায়ের মতোই ক্ষমাশীল। সেই যে মা সারদা বলেছেন - সন্তান ধুলো মাখলে তার গায়ের ধুলো পরিষ্কার করে কোলে তুলে নেওয়াই মায়ের কাজ। আমার ভিতর সেই মা আর সন্তান একসঙ্গে বেঁচে থাকুক এই আমার চাওয়া, তাই ভীমপলাশিকেও আমার মতন করেই আপন করেছি। সে নরম। বৃষ্টি ভেজা মাটির মতো অভিমানি, আলতো চাপেই টোল খেয়ে যায়। ভীমপলাশি শান্ত রাগ। নিজের কষ্ট সে গোপন রাখতে ভালোবাসে। কোমল গা, কোমল নি ঘুরে হাল্কা শুদ্ধ ধৈবত ছুঁয়ে শুদ্ধ মধ্যমে এসে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর আস্তে আস্তে পঞ্চম ছোঁয়। দাদিয়ার (আমার ঠাকুরদা) বাড়িতে জেঠুর কেনা একটা রেকর্ড প্লেয়ার ছিল। আমরা তুতো-ভাইবোনেরা উৎসবের দিনগুলোতে একসঙ্গে হলেই দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই মিলে ওই রেকর্ড প্লেয়ারের ওপর ঝুঁকে পড়তাম। দাদাভাই একমাত্র জানত গোল চলন্ত চাকতির ওপর চাটুর মত রেকর্ড চাপিয়ে টুথব্রাশের মতন জিনিসটা আলতো করে রেকর্ডের কানা ঘেঁষে কেমন করে বসিয়ে দিতে হয় আর সঙ্গে সঙ্গে গান বাজতে শুরু করে। সেই দুপুরগুলো মনে পড়ে। “আমার সাধ না মিটিলো আশা না পুরিলো সকলই ফুরায়ে যায় মা” - পান্নালাল ভট্টাচার্যের গলায় এই গান শুনে তখনও আমার গলা বুজে যেত। আহা কী দরদ, কী প্রেম, কী মায়া সে গলায়! ঠাম্মারা পানের ডাবা নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে গল্পে মজতেন। এলো করে শাড়ি পরা ঠাম্মার গায়ের রং ছিল ধবধবে। মুখে পান, বাংলাদেশি বুলি। আর রান্না? হাত চেটে চেটে ফর্সা করে ফেলতাম সেই রান্নার গুণে। আমায় ডাকতেন ‘মামণি আমার সুনা (সোনা)।’ সব দুপুরবেলাগুলো হারিয়ে গেছে। কত সহজ, সামান্য আর আনন্দময় নিশ্চিন্তির দিন সেসব। সেইসব ভালোবাসার মানুষজনের গায়ের গন্ধ পাই দুপুরের ভীমপলাশিতে। মনে হয় কতদিন তারা নেই। অসহায় অক্ষম আমি মনকেমন করা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারি না তাদের তর্পণে। বাবা-মাও একদিন এভাবেই ভীমপলাশিতে মিশে যাবেন। কুট্টুস মিঠাই, একদিন আমিও। পান্নালালের সেই গানটিও ভীমপলাশির সুরেই।

        শীতের দিনগুলোয় বাড়ির ছাতে মাদুর বিছিয়ে লেপ গরম করতে দেওয়া হত। রোদ হেলে পড়ার আগেই ভাঁজ করে ঘরে এনে চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার। কনকনে রাতে একলাফে বিছানায় উঠে সেই লেপ খুলে গায়ে দিলে রোদের মিষ্টি গরম ওম পাওয়া যেততার ভাঁজে ভাঁজে। সেই রাজসিক ঘুমের কোনো বিকল্প হয় না। দুপুরের খাওয়া মিটিয়ে কমলালেবু আর অঙ্কের খাতা - দুই চরমপন্থিকে সঙ্গে নিয়ে লেপের ওপর গড়াগড়ি খেতাম। মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে উড়ে যেত লম্বা ধোঁয়ার লেজওয়ালা জেট প্লেন। মায়ের হাতে উল কাঁটা থেকে ঝোলা অর্ধেক বোনা সোয়েটার, কোলে তারাশঙ্কর, পিঠে কোঁকড়ানো চুল মেলে রাখা। মায়ের বাঁ-হাতের তালু খুব নরম ছিল, আমার কপালে ছোঁয়ালেই ঘুমিয়ে পড়তাম। তখন মোবাইল ফোনের যন্ত্রণা ছিল না। পিয়োনের সাইকেলের ঘন্টি শুনলেই বুঝতাম নানাজির চিঠি এসেছে। শীতের দুপুর খুব জলদি ফুরিয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে ধোঁয়া ধোঁয়া স্যাঁতস্যাঁতে আর মনমরা হয়ে যায় সবকিছু। এখন খুপরি ফ্ল্যাটে এসির ঠাণ্ডায় বসে বারোমাস এই শহরের মাথার ওপরের ফ্যাকাশে আকাশ দেখায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। নিটোল, টিকিট মারা গাঢ় কমলা রঙের লেবু ইচ্ছে করলেই আজকাল সামনে হাজির হয়, তারপরেও কেন যে সেই ছোটো ত্যাবড়া অথচ মধুর মত মিষ্টি কমলালেবুর গন্ধ ভেসে আসে বুঝি না। আমার বয়েস হচ্ছে। এই যে টুক করে ঝলমলে একটা দুপুর শীতল নিষ্প্রাণ অন্ধকার সন্ধের গভীরে তলিয়ে গেল কিছুমাত্র বুঝতে না দিয়ে তাতেই বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে। জলের নীচে বালি যেমন সরে সরে যায় অজান্তে তেমনই অনেক কিছুই যেন সেই অনাকাঙ্ক্ষিত শীতলতার মধ্যে ডুবে যায়। হারিয়ে যাবে, যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত। এরকম কত কত মানুষের কত সহস্র দুপুরবেলা হারিয়ে গেছে। সকাল দুপুর সন্ধে সবই আজকাল একরকম। ব্যস্ত, বিরক্ত বিবর্ণ হতাশ ফেসবুকময় আর উৎকণ্ঠার। রবীন্দ্রনাথ সংগীতচিন্তার ছিন্নপত্রাবলীতে ইন্দিরা দেবীকে রাগ মুলতানি বিষয়ে বলছেন - ‘... আজ আমি এই অপরাহ্ণের ঝিকমিকি আলোতে জলে স্থলে শূন্যে সব জায়গাতেই সেই মূলতান রাগিণীটাকে তার করুণ চড়া অন্তরা-সুদ্ধ প্রত্যক্ষ দেখতে পাচ্ছি-না সুখ, না দুঃখ, কেবল আলস্যের অবসাদ এবং তার ভিতরকার একটা মর্মগত বেদনা”। মহৎ প্রাণের ব্যথাবোধ অবর্ণনীয় কিন্তু ক্ষুদ্র প্রাণীও তো কষ্ট পায়, যদিও সে হয়তো জগতের উত্থান-পতনের খেলার বিশিষ্ট পদাধিকারী নয়, কিন্তু এই ভুবনজোড়া কর্মকাণ্ডের ভাগীদার তো বটে! তার ব্যথাতুর নগণ্য শ্বাসপ্রশ্বাসও বাতাসকে ভারী করে, মুহূর্তে অতীত হতে থাকা বর্তমানকে স্মরণ করতে শেখায়। যা কিছুই পড়ে থাকে ‘সুখ নয় সে দুঃখ সে নয় নয় সে কামনা’। সে যে কিসের হাহাকার তা আমি জানি না।

        মুলতানিকে ‘সাঁঝ কি টোড়ি’ অর্থাৎ সন্ধ্যাবেলার টোড়ি বলা হয় কারণ এর সপ্তকে ভোরের রাগ টোড়ির মতনই রেখাব ধৈবত কোমল আর মধ্যম তীব্র কিন্তু তার জীয়ন কাঠিটি লুকিয়ে রাখা কোমল রে আর কোমল ধা-এর প্রয়োগ-কৌশলে। কুমারমামা বলতেন - ‘খুউব ডেলিকেট’। টোড়ি ঠাটের রাগ মুলতানি। অবরোহণে কোমল ধা আর কোমল রে খুব আলতো ভাবে আর অল্প সময়ের জন্য প্রয়োগ হয়, ‘পা ধা(কোমল)প’ বা ‘সা রে(কোমল)সা’ এই সঙ্গতিতে আর তাতেই পড়ে আসা বিকেলের ক্ষয়ে যাওয়া রূপটি যথার্থ ফুটে ওঠে।

        ‘লাল লাঠি’ খেলতাম আমরা, মাথায় একটা লম্বা লাঠি লম্বালম্বি শুইয়ে হেঁটে যেতে হত। সে এক অদ্ভুত মজার খেলা। গোটা পাড়া হেঁটে ছুটে মাতিয়ে রাখতাম। পাড়ার মধ্যিখানে বড়ো খোলা মাঠের এক কোণ থেকে কয়লা কালো মেঘ ঘনিয়ে ব্যাঙার বাগানের মাথা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ত। ক্ষণিকের মধ্যে গোবিন্দ জেঠুর বাড়ির লম্বা ক্রিসমাস ট্রি আর সুপুরি গাছের সারি দুলতে শুরু করলেই বাড়িমুখো ছুট লাগাতাম। ঘরে পা দেবার আগেই জলে ভিজে যেত গা-মুখ-মাথা। সেই জল এখনও গড়িয়ে পড়ছে কপাল চুইয়ে গাল বেয়ে আর ভিজে সপসপে হয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ কলকাতার হাইরাইসের দেয়াল, শপিং মলের পাপোশ, ভিক্টোরিয়ার পরি। মুন্নার বাবা মারা গেলেন বেশ কম বয়েসেই। সেসময় প্রতিটা দুপুর আমি ওদের বাড়ির ছাতে কাটাতাম। পুতুল কাকিমা, অসম্ভব শান্ত আর ঠান্ডা মানুষটা আরও শীতল আর নিশ্চুপ হয়ে গেছিলেন। মুন্নার মাথার চুল তেল ছাড়া রুক্ষ হয়ে যাচ্ছিল। মনে পড়ে ও শুকনো চোখে একমনে জমা খরচের হিসেব করত কারণ সংসার চালু থাকবার মতো ভরসা কোথাও ছিল না। এই সব সাধারণ তুচ্ছ পরিচিত ঘটনাগুলো জীবনের কোনো এক সময় অবলম্বন হয়ে পড়ে। জানলা দিয়ে সবুজ ময়দানের বুকে চরতে থাকা ঘোড়াগুলোর দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবি, ভাবতে ভাবতে এমন মনে হয় যেন এই সেদিন তো ঘটে গেল এইসব! সময়ের পাখা এক পলকে পুড়ে যায়।

        বিকেলের গায়ে হেলে পড়া দুপুরের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া মানুষজন, সময় আর অফুরান প্রাণশক্তি সব এক লহমায় ফিরে আসে পটদীপের শুদ্ধ নিষাদের সুরে। সুতীব্র আর তীক্ষ্ণ সেই নিষাদ অদৃশ্য নখের আঁচড় কাটতে থাকে বুকের গভীরে আর লাল রক্তের দাগ ফুটে ওঠে সেই জেট প্লেনের পিছনে ধোঁয়ার লম্বা লেজের মতো। তার সঙ্গেই চিনচিন করে ব্যথা হয়। চোখ ভারী হয়ে আসে। নিজেকে নিঃস্ব আর অসহায় মনে হয় আর সত্যি বলে যদি কিছু শব্দ আদৌ থাকে এই ধরাধামে তা হল অসহায়তা। ‘পথের পাঁচালী’ প্রথম কবে দেখি মনে নেই। এই এত বছরে আরও কতবার দেখেছি তাও গুণে বলতে পারব না। অভাবে জর্জরিত মলিন ভাঙা উঠোনে হরিহর বাক্স খুলে দুর্গাপুজোর উপহার বের করছেন একে একে। মুখে তার স্বস্তি আর সামান্য সাফল্যের হাসি। তার অপর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে সর্বজয়া, কোনো এক দাবানল যেন পুড়িয়ে কালি করে দিয়েছে তার মুখ। দামাল মেয়ে দুর্গার জন্য একটা শাড়ি এনেছেন হরিহর আর তিনি নিশ্চিত এই কাপড়ে তাকে ভারি সুন্দর মানাবে। ধ্বসে যাওয়া মাটির বাড়ির মতো মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়েন সর্বজয়া। তার ডুকরে ওঠা শরীর মাটিতে পড়ে থরথর করতে থাকে। স্তম্ভিত হরিহর মেয়ের মৃত্যুর কথা জেনে যান আর দুই মানুষের নির্বাক কান্নার পিছনে ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মত খানখান হয়ে বেরিয়ে আসে দক্ষিণা মোহন ঠাকুরের তারসানাই। রাগ পটদীপ। মন্দ্র সপ্তক থেকে গুমরে গুমরে ক্রমশ পাকিয়ে পাকিয়ে উঠতে থাকে আর রক্তাক্ত করতে করতে তা উড়ে চলে তার সপ্তকের দিকে। সে যে কী ভয়ঙ্কর! পৈশাচিক! পৃথিবীর সকল প্রজাতি - মানুষ জন্তু কীট - সকলের বিপন্নতার এক অনির্বচনীয় আর্তনাদ। সংগীত এতখানি পারে! এ একমাত্র সংগীতই পারে। আমি পটদীপকে ভয় পাই। কী জানি কোনো অজানা হাহাকার পঞ্চম থেকে শুদ্ধ নিষাদের মীড়ে আমাকে চুরমার করে দিয়ে যাবে এক লহমায়!

        ‘ত্রিবেণী তীর্থ পথে কে গাহিল গান’ - চিন্ময় লাহিড়ী আর প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় সেই গান অথবা ‘প্রথম প্রদীপ জ্বালো মম ভবনে’ নজরূলের সেই গানে পটদীপ অন্য আঙ্গিকে ধরা দিয়েছে। এখানে তার সুতীব্র চিৎকার অনুপস্থিত। এভাবেই তো সময়, প্রেক্ষিত আর অভিমানের সামান্য এদিক সেদিকে প্রকৃতি বা মানুষের মত রাগের মন ও পালটে যায়। পালটে যায় তার কথা বলার ধরন, চাউনির দিশা, চলার ছন্দ। কাফি ঠাটের রাগ পটদীপ যদিও তার পাগল করে দেওয়া নিষাদটি শুদ্ধ।

        ছেলেবেলার দিনগুলো যে পথে হারিয়ে গেছে সেদিকেই হাঁটতে ইচ্ছে হয় আজকাল। শীতের দুপুরে পূজাবার্ষিকীর রঙিন মলাটে বিমল দাশের আঁকা ছবি, সন্দেশে নতুন শঙ্কুবাবুর অভিযান, কিশোর ভারতীর ভূতের গল্প সঙ্গে নিজের অনভ্যস্ত হাতে আঁকা এটা-সেটা, নড়বড়ে ছন্দে লেখা কবিতা এই সব কিছু নিয়ে নিরলস ভাবতে ভালো লাগে। ময়দানে একপাল ছেলে মেয়ে ফুটবল খেলছে। তার আগে তারা গোল হয়ে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে গান গায়। তাদের গায়ে রংবেরঙের জার্সি। ভেজা ঘাসের ওপর লম্বা হয়ে পড়ছে তাদের ছায়া, প্রত্যেকের ছায়া তাদের সঙ্গেসঙ্গেছুটে বেড়াচ্ছে সারা মাঠ। ঝাঁক বেঁধে উড়ে আসছে সাদা বক আর পায়রার দল। কিছুক্ষণের জন্য তারাও ঘাসের ওপর দম নিতে বসে। আমার অফিসের জানলা দিয়ে দেখা যায় সব। নানাজি বলতেন ‘আপিস’। টাক মাথা, দীর্ঘ সুঠাম চেহারার এক ভদ্রলোক পাশের উঁচু বাড়ির ছাদে প্রত্যেকদিন ঠিক দুপুরবেলা হনহন করে আধঘন্টা-টাক হাঁটেন। বৃষ্টিতেও দমেন না, ছাতা হাতে হেঁটে চলেন। হয়তো রোগব্যাধিবালাই দূর করতেই, কিন্তু আমার অবাক লাগে হাত-খানেক দুরেই কাঁচা সবুজ কার্পেটে মোড়া অমন একটা মাঠ থাকতে উনি ছাতের মেঝের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেই কীভাবে যে সময়টা কাটিয়ে ফেলেন! যখন ভীমপলাশি, মুলতানি বা পটদীপ শিখেছি বুঝতেই পারিনি বাকি জীবনের প্রত্যেক দুপুরে একবার করে তারা কড়া নেড়ে দিয়ে যাবে এরা। যা কিছুই দেখি, যেসব ঘটনা কাগজে নয়তো টেলিভিশনের খবরের চ্যানেলের রোজ সন্ধের ঝালমুড়ি অথবা দিনের রাতের সমস্ত টুকিটাকি সব এই দুপুরের আলসেমির ছুতোয় মনখারাপের হাতচিঠি নিয়ে আসে। শহরের বেশিরভাগ আকাশ, যা আমার জানলা দিয়ে দেখা যায়, নিরন্তর বিমর্ষ থাকে। এই বর্ষায় দিগন্তের শেষ কিনারা থেকে কুয়াশার মতো বৃষ্টি এগিয়ে আসে, যত কাছে আসে তার শব্দ শোনা যায়। অতীত থেকে সেভাবেই ভেসে আসে সুর, গান, সখ্য, আর দুপুরবেলা। বুকের কাছাকাছি এলে তবে তার শব্দ শুনতে পাই। জীবনের অনেক হয়ত এখনও দেখার বাকি, তবু এই এক্ষুনি যদি স্তব্ধ হয়ে যায় সব, আমার কিছুমাত্র আফসোস থাকবে না। কত কিছুর মায়া, ভালোবাসা আর প্রাপ্তিতে পূর্ণ হয়ে আছি। এই যে আমার মনকেমন, এর জন্যেও তো নিজেকে প্রস্তুত করেছি, দুঃখই যদি না পেলাম তবে আর গানই শিখলাম কেন!

1111-removebg-preview.png

গল্পের বই উপহার পেতে কে না চায়!
এখনই Subscribe  করুন,
আর পেয়ে যান আপনার প্রথম বইটির মূদ্রিত মূল্যের ওপর ২৫% ছাড় 

Thanks for being our family!

  • Youtube
  • pngwing.com
  • 1111
  • tumblr
  • Instagram LOGO PNG2

+91 8240333741

Magic Seeds Books LLP

119 Abhay Patuli Lane, Shuksanatantala, Chandannagar 712136

Email us at: manikarnika.pub@gmail.com

For any other queries feel free to reach us at: 8240333741(Call/Whatsapp)

©2022 by Manikarnika Prakashani.

bottom of page