কাল তোমাকে দেখতে পেয়েছি। শেষরাত্রের কাটা-চাঁদের ও শুকতারার পেছনে তুমি ছিলে। এই শেষ রাতের আকাশের পেছনে, এই ফুল ফোটা নিমগাছের ডালের সঙ্গে, এই সুন্দর শান্ত ঘন নীল আকাশে এক হয়ে কেমন করে তুমি জড়িয়ে আছ। কত প্রাণী, কত গাছপালার বংশ তৈরী হ’ল, আবার চলে গেল - ঐ যে পায়রাদল উড়ছে, ঐ যে নারকেল গাছটার মাথা ভোরের বাতাসে কাঁপছে, ঐ যে বন-মূলোর ঝাড় ছাদের আলসেতে জন্মেছে, আমার ছাত্র বিভূতি - দু-হাজার বছর আগে এরা সব কোথায় ছিল? দু’হাজার বছর পরেই বা কোথায় থাকবে? এদের সমস্ত ছোটখাটো সুখদুঃখ আনন্দ-হতাশা নিয়ে ছোট্ট বুদ্ধুদের মত অনন্ত গহন গভীর কালসমুদ্রে কোথায় মিলিয়ে যাবে, তার ঠিকানাও মিলবে না - আবার নতুন লোকজন ছেলেপিলে আসবে, আবার নতুন ফুলফলের দল আসবে, আবার নতুন সব সুখদৈন্য হর্ষহতাশা আসবে, কত মিষ্টি জ্যোৎস্না-রাত্রির মাধবী বাতাস আবার বইবে, পুরোনো উজ্জয়িনীর কেশধূপ বাস যেমন মদির ছিল, ভবিষ্যৎ কোন বিলাস-উজ্জয়িনীতে নতুন কেশরাশি পুরোনো দিনের চেয়ে কিছু কম মদির হয়ে উঠবে না, কত গ্রাম্য-নদী ভবিষ্যতের অনাগত গ্রাম-বধূদের সুখদুঃখ সম্ভার নিয়ে বয়ে চলবে… আবার তারা যাবে, আবার নতুন দল আসবে।
কিন্তু তুমি ঠিক আছ। হে অনন্ত, যুগে যুগে তুমি কখনো বদলে যাও না। সমস্ত পরিবর্ত্তনের মধ্য দিয়ে, সমস্ত ধ্বংস-সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অপরিবর্ত্তিত, অনাহত তুমি যুগ থেকে যুগান্তরে চলেছ। এই দৃশ্যমান পৃথিবী যখন আকাশে জ্বলন্ত বাষ্পপিণ্ড ছিল, তারও কত অনন্তকাল পূর্ব্ব থেকে তুমি আছ, এই পৃথিবী যখন আবার কোন দূর অনির্দ্দিষ্ট ভবিষ্যতে, যখন আবার জড় পদার্থের টুকরোতে রূপান্তরিত হয়ে দিকহারা উল্কার গতিতে উদ্ভ্রান্ত হয়ে অনন্ত ব্যোমে ছোটাছুটি করবে, তখনও তুমি থাকবে। কালের অতীত, সীমার অতীত, জ্ঞানের অতীত কে তুমি - তোমাকে চেনা যায় না। অথচ মনে হয়, এই যেন বুঝলাম, এই যেন চিনলাম। শেষ রাত্রের নদীর জলে যখন চিকচিকে মিষ্টি জ্যোৎস্না পড়ে, শেওলায় কূলে তাল দেয়, তখন মনে হয় সেখানে তুমি আছ, ছোট্ট ছেলে তার কচি মুখ নিয়ে ভুরভুরে কচিগন্ধ সমস্ত গায়ে মেখে যখন নরম হাতদুটি দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে, যেন মনে হয় সেখানে তুমি আছ, ওরায়ণ যখন পৃধিবীর গতিতে সমস্ত রাত্রির পরে দূর পশ্চিম আকাশে ঝুলে পড়ে, সেই রুদ্র প্রচণ্ড অথচ না-ধরা-দেওয়া-গতির বেগে তুমি আছ, জনহীন মাঠের ধারে গ্রাম্য ফুলের দল যখন ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে অকারণে হাসে তখন মনে হয় তাদের সেই সরল প্রাণের প্রাচুর্য্য তার মধ্যে তুমি আছ।
তাই বলছিলাম যে কাল শেষরাত্রে তোমাকে হঠাৎ দেখলাম। অন্ধকার প্রহরের শেষ রাত্রের চাঁদ তার পার্শ্ববর্ত্তী শুকতারার পেছনে। তোমায় প্রণাম করি -
আজ কলেজের কালভার্ট বেয়ে উঠছিলাম। বেলা পাঁচটা, ঠিক সন্ধ্যেটা হয়ে এসেছে, ছোট ছোট সেই অজানা রাঙা ফুলগাছগুলোর দিকে চেয়ে কেমন হঠাৎ আনন্দ এসে পৌঁছলো - নাথনগরের আমগাছগুলোর ওপর সূর্য্য অস্ত যাচ্ছে, কেমন রাঙা হয়ে উঠেছে সেদিকের আকাশটা - এই সামান্য জিনিষের আনন্দ, কচিমুখের অকারণ হাসি, রাঙা ফুলগাছটা, নীল আকাশের প্রথম তারা, ঐ যে পাখীটা বাঁকা ডালে বসে আছে, সবশুদ্ধ মিলে এক এক সময় জীবনের কেমন গভীর আনন্দ এক এক মুহূর্ত্তে আসে।
মানুষ এই আনন্দ জানতে না পেরেই অসুখে, হিংসায় স্বার্থদ্বন্দ্বে সুখ খুঁজতে গিয়ে নিজেকে আরও অসুখী করে তোলে… আজ যে মার্টিন লুথারের জীবনী পড়ছিলাম, তাতে মনে হোল এক এক সময় এক-একজন ব্রাত্যমন নিয়ে পৃথিবীতে এসে শুধু যে নিজেই স্বাধীন মত ব্যক্ত করে চলে যায় তা নয়, জড়মনকেও বন্ধন-মুক্ত করে দেবার সাহায্য করে। যেমন সহস্র বৎসরের পুঞ্জীকৃত অন্ধকার এক মুহূর্ত্তের একটা দেশলাইয়ের কাঠির আলোতেই চলে যায় - তেমনি।
কাউকে ঘৃণা করতে হবে না। এ জগতে যারা হিংসুক, স্বার্থান্ধ নীচমনা তাদের আমরা যেন ঘৃণা না করি… শুধু উচ্চ জীবনানন্দ তাদের দেখিয়ে দেবার কেউ নেই বলেই তারা ঐ রকম হয়ে আছে। কোন্ মুক্ত পুরুষ অনন্ত অধিকারের বার্ত্তা তাদের উপেক্ষিত বুভুক্ষাশীর্ণ প্রাণে পৌঁছে দেবে?
॥ ২৭শে অক্টোবর, ১৯২৪, কলিকাতা ॥