top of page

মাংসাশী ও বিশল্যকরণী । বাসুদেব মালাকর

8b1d4e_fce1bb65f7af4e2e99536ef3bb88efd4~mv2.jpg

বিষয় : গল্প

প্রচ্ছদ : ইয়োকোডিজাইন

মণিকর্ণিকা প্রকাশনী

মূল্য : ₹৩০০

যোগাযোগ (কল ও হোয়াটস্অ্যাপ) : 8240333741

Amazon Button PNG.png
Our Store Button PNG.png
আগ্রহী পাঠকদের জন্য বইটির একটি গল্প এখানে দেওয়া হল।

সাপলুডো

 

বাসুদেব মালাকার

 

হিরণের মোবাইলের রিংটোনটার ভিতর একটা প্রগাঢ় অভিমান আছে— ‘কেন ডাকো তুমি মোরে/ দিশাহীন আমি পথ খুঁজে খুঁজে হারিয়ে গিয়েছি অন্ধকারে…’ জনপ্রিয় এই গানটিকে পিয়ানোয় বাজিয়ে মোবাইল কোম্পানি রিংটোন করে বাজারে ছেড়েছিল, হিরণ সেটাকেই তাঁর মোবাইলে নিয়েছে।

       কেন নিয়েছে, সে নিজেই জানে না। তার মসৃণ জীবনযাত্রার ভিতর গভীর কোনও অভিমানের অবকাশ নেই, সে যে চাকরিটা করে, স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে বেঁচে থাকার পক্ষে সেটা অনেক বেশি। একটা ক্রমোন্নতিশীল সংস্থার দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখায় পৃথক চেম্বারে তার বসবার জায়গা, একজন একান্ত সচিব এবং স্টেনোও আছে। সংস্থা তাঁকে ফ্ল্যাট মঞ্জুর করেছিল, ফ্ল্যাটের জীবনযাত্রা তার বউয়ের পছন্দ নয় বলে সে সেটা ফিরিয়ে দিয়েছে। ফলে শহরের উপকণ্ঠে তার নিজস্ব দোতলা বাড়ি, বাড়িতে বউ, সাত বছরের ফুটফুটে মেয়ে নিয়ে তার তৃপ্ত সাবলীল জীবন। কমপক্ষে চারজন সিনিয়রকে টপকে তার আজকের এই উত্থানের জন্য সে ভিতরে একটু অহংকারী এবং অন্যের ঈর্ষার পাত্র।

       শুধু একটা কাঁটাই মাঝে মাঝে তাঁকে বিদ্ধ করে— তার একমাত্র বোন হেনার বিয়েটা সুখের হয়নি! জীবনের সব কটা দানই সে নির্ভুল চেলেছে, হেনার বেলায়ই চালটা নির্ভুল হল না!

        ভাল ঘ-বর দেখে হিরণ মনে করেছিল, হেনা ওখানে সুখেই থাকবে, কিন্তু হেনা বউ হয়ে গিয়ে বুঝেছিল, পার্থর মতো একটা মানুষের সঙ্গে জীবন কাটানো অসম্ভব। উদ্ধত হৃদয়হীন বিকৃতরুচি, সবচেয়ে বড় কথা, ভালোবাসাহীন পার্থর সঙ্গে নরম স্নিগ্ধ হেনার কোনও আত্মিক সংযোগ তৈরি হয়নি।

        বিয়ের আগে হেনা যে একজনকে ভালবাসত, এই তথ্যটুকু— যা তার উপর নির্যাতন হয়ে নেমে এসেছে— গোপন থাকেনি যেমন, হেনাও তেমনই আবিষ্কার করেছিল! পার্থর সঙ্গে তার এক সম্পর্কিত প্রায় সমবয়সী বউদির একটি অনুচিত সম্পর্ক আছে। প্রকৃতপক্ষে সেই মহিলাই সংসারের কর্ত্রী এবং পার্থর চালিকাশক্তি। পার্থর মা-বাবা ছেলের বিয়ে দিয়ে মতি ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন, পার্থর এক জামাইবাবু উদ্যোগী হয়ে হিরণের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন পরিচিতির সূত্র ধরে।

        হেনা এ বিয়েতে রাজি ছিল না, হিরণই খানিকটা জোর খাটিয়ে রাজি করিয়েছিল বোনকে।

       সেই বউদির সঙ্গে পার্থর সম্পর্কটা এখন খোলাখুলি। প্রায়ই তিনি আসেন। হেনা তখন বসার ঘরে টিভি চালিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।

      অপমান অবহেলা প্রথম থেকেই ছিল, এখন ছুতোনাতায় গায়ে হাত তোলাও শুরু হয়েছে। একটাই বাঁচোয়া, সাড়ে তিন বছরে এখনও হেনা মা হয়নি। পার্থ বলেছে, ‘বেডরুমটাকে বাচ্চার গু-মুতের গন্ধে ভরাতে না পারলে মজা হচ্ছে না, না?’

      এই একমাত্র বার্থতার জন্যই হিরণ তার মোবাইলে অমন গভীর অভিমান পুষে রেখেছে কি না, সে নিজেই জানে না।

 

দুপুরবেলা লাঞ্চ-রিসেসের একটু পরেই হিরণের মোবাইলে সেই অভিমান গুমরে উঠল। স্ক্রিনে তমালিকার নাম। তমালিকা এসময় ফোন করে না, মুনকে স্কুল থেকে স্নান করিয়ে খাইয়ে দিয়ে সে নিজেও একটু বিশ্রাম নেয়।

      হিরণ একই সঙ্গে বিস্মিত ও শঙ্কিত হয়ে কলটা রিসিভ করে বলল, ‘বলো, অসময়ে হঠাৎ?’

   যা ভেবেছিল, ওদিকে তমালিকার স্বরে একটু কাঁপনের সঙ্গে অবয়বহীন অসহায়তা, ‘শোনো, তুমি সকালে বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই দূর্বাদল এসেছে!’

     হিরণ বিস্মিত হল, দূর্বা! কেন? কী বলল এসে? এখন কী করছে?

      একই সঙ্গে এতগুলো প্রশ্ন করবার পর সে নিজেকেই বলল, ধীরে রজনী, মাথা ঠান্ডা করে বুঝতে হবে সবকিছু আগে।

       বারোশো স্কয়ার ফুটের মাঝারি বাড়ি, পাশাপাশি ঘর, তমালিকা প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘এসে বলল, স্নান করব, বউদি। খেতে ডাকলাম, খেল। এখন সামনের ঘরে সোফায় আধশোয়া হয়ে ম্যাগাজিন দেখছে।’

      হিরণ একটু নিশ্চিন্ত হল, বলল, ‘শোনো, ঘাবড়াবার কিছু নেই। কথা-টথা বলো। তুমি তো আগেও দেখেছ ওঁকে, আমাদের বিয়ের সময় এসেছিল। সম্পর্কটাও জানো।’

    তমালিকা বলল, ‘কী কথা বলব? আমার খুব ভয় করছে। চোখ দু’টো কেমন জ্বলজ্বল করছে। দু’চারটে কথা যা হয়েছে, চোখের দিক তাকেতে পারিনি।’

     হিরণ হাসল, ‘তোমার না সবকিছুতেই ভয়। কেন, ও কি বাঘ না ভালুক? আরে, ওর চোখ দু’টো ছোটোবেলা থেকেই ওরকম— উজ্জ্বল, ঝকঝকে। বেসিক্যালি ও কিন্তু খারাপ ছিল না। ওর সম্পর্কে যা শুনেছ, সেজন্যই হয়তো ভয় পাচ্ছ...।’

     তমালিকা বলল, ‘থাক্‌, নিজের আত্মীয়স্বজনের গুণ আর গাইতে হবে না! কম তো দেখলাম না— গুণের নিধি এক-একটা।’

    হিরণ পরিস্থিতিটাকে একটু হালকা করবার জন্য বলল, ‘দুর, ও আমাদের আত্মীয় হল কবে? ছোটোবেলায় পাশাপাশি বড় হয়েছি, দুই ফ্যামিলির মধ্যে ভাব-ভালবাসা ছিল— এটুকুই। ওর চোখের কথা বললে না? তুমি তো লিটারেচারের— বাঙ্ময় বলে একটা শব্দ আছে না? ওর চোখ দু’টো বরাবরই সেরকম। মুখে যতটা বলে, চোখ দিয়ে বলে তার চেয়ে বেশি!’

     তমালিকা কণ্ঠে বিষ মিশিয়ে বলল, ‘কী প্রেম! একটা ইয়ের চোখের দৃষ্টি নিয়ে উনি সেফ ডিসট্যান্সে বসে কাব্য করছেন?’

     হিরণ ব্যঙ্গটা হজম করে বলল, ‘টেনশন নেওয়ার দরকার নেই, এক কাজ করো, মুন ঘুম থেকে উঠলে ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও— বাচ্চাদের সঙ্গে ও খুব তাড়াতাড়ি ভাব করতে পারে।

      তমালিকা বেশ আর্তনাদ করে উঠল, ‘কী বুদ্ধি! আমার ওই সাত বছরের মেয়েকে আমি ওর মতো একটা দাগি ক্রিমিনালের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে ছেড়ে দিই! আর তোমার মেয়েও হয়েছে তেমনই, দুপুরে ঘুমোয়নি। তোমার পরমাত্মীয় একবার হাতছানি দিয়ে ডেকেছে, অমনি গিয়ে ভাব করা হয়ে গেছে এরই মধ্যে। ছড়া বাঁধা ক্যুইজও হয়ে গেছে। বজ্জাত মেয়ে কোথাকার। একটু আগে জোর করে টেনে এনে শুইয়ে দিয়েছি। দয়া করে আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরলে বাধিত হব। ছাড়ছি।

দুই

 

মোবাইলটা অফ করবার পর হিরণের ভিতর একজন হিসেবি উচ্চপদাধিকারী জেগে উঠে তমালিকার আশঙ্কাটুকুর পোস্টমর্টেম করবার চেষ্টা করল।

       তমালিকার কথাগুলো উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। সে যতটা ভেবেছে, ততটা না হলেও, এই মুহূর্তে তার বাইরের ঘর একটা জেলখাটা খুনের আসামি বসে আছে, ভেবেই হিরণ অসহায় বোধ করতে শুরু করল। তার একটা নিজস্ব পরিচিতি আছে, সমাজ আছে, প্রতিবেশী আত্মীয় সুহৃদ এবং কিছু শত্রুও আছে। সবচেয়ে বড় কথা, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার চাকরির নিরাপত্তা। যদি একবার জানাজানি হয়ে যায় যে, হিরণ মল্লিকের বাড়িতে একটা খুনের আসামি এসে উঠেছে, কোথায় থাকবে তিল তিল করে গড়ে তোলা এই সম্মান প্রতিষ্ঠা? দেশবিদেশে সুনামের সঙ্গে ক্রমস্ফীত এক সংস্থা— যার শেয়ারের মূল্য কখনও নিম্নগামী হয়নি— তার পদস্থ আধিকারিকের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে একটা ক্রিমিনাল! হিরণ একটু টাল খেয়ে গেল।

       হঠাৎ এতদিন পরে দূর্বাদল কেন এল, ক্রিমিনালরা সাধারণত একলা হয় না, দূর্বা কি দুর্যোগের হিমবাহের চূড়া— যার অতলে আরও বড় অদৃশ্য কোনও দুর্গ্রহ তার শান্ত সুন্দর সংসারের দিকে শরসন্ধান করছে? ছোটোবেলার সেই সুসম্পর্কের দাবি এত দূরে পৌঁছাতে পারে?

       হিরণ যতই ভাবছিল, দুপুরটা ততই দীর্ঘ হচ্ছিল। টেবিলে অনেকগুলো ফাইল জমে গেছে, আগামী দু’দিনের মধ্যে ওগুলোকে ছাড়তে হবে। নাইজিরিয়া থেকে একটা রিকুইজিশন এসেছে— টপ প্রায়োরিটি— ওটার ব্যাপারে ডিরেকটরদের সঙ্গে বসতে হবে। কিন্তু কোনও কাজেই মন বসাতে পারছিল না হিরণ। এক সময় সে তার পি.এ-কে বলে বেরিয়ে পড়ল।

 

গেট খুলে বাড়িতে ঢুকেই তার মনে হল, সবকিছু যেন অন্য দিনের থেকে একটু আলাদা! কয়েক পা এগোলেই বারান্দায় ওঠার তিন ধাপ সিঁড়ি, ডাইনে-বাঁয়ে তমালিকার শখের বাগান। মরসুমের গাঁদা দোপাটি, সারা বছরের নয়নতারা গোলাপ জবা নিয়ে তার এই শখের মালঞ্চ— ফ্ল্যাটবাড়িতে এই সৃজনটুকু এবং আরও আনেক কিছুরই অবকাশ নেই বলেই তমালিকা ফ্ল্যাটবাড়ি নাকচ করেছিল; আজ তার সেই সৃজনের গোড়ায় জল পড়েনি। তার মানে আজ বিকেলে সে নীচে নামেনি!

       কলিংবেল বাজাতে তমালিকাই দরজা খুলল। তার দু’চোখে রাগ অভিমান এবং শঙ্কা। তমালিকার পিছনে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে হিরণ জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায়?’

       তমালিকা ইশারায় বাইরের ঘরটা দেখাল।

       জামাপ্যান্ট ছেড়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে হিরণ যখন ঘরে দূর্বা তখন বিছানার উপর পদ্মাসনে বসে। পরনে স্টিল কালারের কারগো ট্রাউজার, শ্যাওলারঙা পাঞ্জাবি। হিরণকে দেখে হেসে বলল, ‘তুমি এসেছ, টের পেয়েছি, কেমন আছ, হিনুদা?’

      দূর্বার মা প্রীতিমাসিমার চেহারা খুবই সুন্দর, দূর্বা সেই সৌন্দর্যের প্রায় সবটুকুই পেয়েছে। যৌবন তাকে আরও লাবণ্যময় করেছে। শ্যামলা দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারা, চওড়া কপালের নীচে খাড়া নাক, তার দু-পাশে বড় বড় দুটো চোখ, একটা স্পষ্ট বিভাজিকা থুতনিটাকে নির্ভুলভাবে দ্বিধাবিভিক্ত করেছে। মাথায় লম্বা এলোমেলো উলুঝুলু চুল।

       হিরণ বলল, ‘এ কী রে! এত বড় বড় চুল রেখেছিস কেন?’

     দূর্বা হেসে বিছানায় থাবা মেরে বলল, ‘বোসো। কতাদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হল! বেশ মুটিয়েছ কিন্তু!’

       দূর্বার পিছনে বসে মুন একটা ছবি আঁকছিল, বাবাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে হাসল।

       হিরণ বলল, ‘এ কী মুন, তুমি এখনও পড়তে বসোনি! এটা কি ড্রইংয়ের সময়’?

       দূর্বা বলল, ‘আমিই বলেছি আঁকতে— উইদ প্রায়র পারমিশন অফ্‌ বউদি!’

      হিরণ বলল, ‘তুই জানিস না, ওদের ইস্কুলে হোমটাস্কের কী ট্রিমেন্ডাস প্রেশার! বল, বিল্বদা মাসিমা কেমন আছেন?’

       দূর্বা ছোট্ট উত্তর দিল, ‘ভাল।’

       মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন বুজকুড়ি তুলছিল, কিন্তু কীভাবে আসল জায়গাটায় পৌঁছনো যায়, হিরণ ভেবে পাচ্ছিল না।

       তমালিকা দরজার সামনে এসে বলল, ‘একটু বাজার যেতে হবে।’

       ‘হ্যাঁ যাই’, বলে হিরণ উঠে দাঁড়াল। দূর্বা মুনের দিকে ঘুরে বসল।

     বাজারে বেরনোর আগে শোওয়ার ঘরে এসে হিরণ জিজ্ঞাসা করল, ‘ওকে বিকেলের চা-টা দিয়েছিলে তো?’

       ‘আশ্চর্য, কেন দেব না! তোমার আত্মীয়স্বজনকে আমি যত্ন করি না, বলতে চাও?’

       ‘ওভাবে বলছ কেন? এসেই যখন পড়েছে, আগে উদ্দেশ্যটা জানতে হবে তো নাকি?’

      ‘উদ্দেশ্য যাই থাক, একটা কথা শুনে রাখো, পাড়ায় আমাদের একটা সুনাম আছে, আমার বাপের বাড়ির লোকজন আছে, বড় কথা, মুনের স্কুলের বন্ধুরা, তাদের পেরেন্টস্— ওর যা ইতিহাস শুনেছি…

       ‘আরে আমিও কি ব্যাপারটা ভাবিনি ভাবছ? একটু ধৈর্য ধর, প্লিজ!’

      ‘শোনো, ও যদি কাল চলে যেতে চায়, তুমি যেন স্নেহ দেখিয়ে বলতে যেও না, আর দু’টো দিন থেকে গেলে পারতিস… আ্যাদ্দিন পরে এলি— তোমাকে চিনতে তো বাকি নেই। শুনেছ, কী বললাম?’

       ‘আমার সঙ্গে সঙ্গে দূর্বা কিন্তু ওঘরে বসেও শুনতে পাচ্ছে!’

       ‘শুনুক, কাজটা সহজ হয়ে যাবে তাহলে।’

 

তিন

 

খাওয়ার টেবিলে হিরণ আর দূর্বা। তমালিকা সার্ভ করছে। মুনকে আগেই খাইয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। কাল শনিবার, মুনের ছুটি, তবু নিয়ম নিয়মই।

         হিরণ জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই কিন্তু বললি না, হঠাৎ কী মনে করে এলি!’

         মা বলত, দূর্বা হাসলে ঘাসের উপর শিউলি ঝরে! তখন খুব হিংসে হত।

        দূর্বা সেই রকম হেসে বলল, ‘এমনিই চলে এলাম। পাসপোর্টটা রিনিউ করতে দিয়েছিলাম ওরা ডেকে পাঠিয়েছিল, ভাবলাম, দেখেই যাই তোমাদের!’

        হিরণ বলল, ‘কী করছিস এখন? একটা গ্রামীণ ব্যাঙ্কে জয়েন করেছিলি শুনেছিলাম। ওটা আছে না গেছে?’

         দূর্বা সংক্ষেপে বলল, ‘গেছে।’

        ‘ফেরত পাওয়া যায় না? তোর তো পানিশমেন্ট হয়নি শুনেছিলাম! ওনলি জেলকাস্টডি?’

        ‘ইউনিয়ন লড়ে যাচ্ছে।’

      হিরণ বুঝতে পারল, দূর্বা এখন একদম বেকার। তার মানে এখানে স্টে করতে ওর কোনও বাধা নেই। কিন্তু সেটা যে কোনওমতেই হতে দেওয়া যাবে না, এই কথাটা কী করে ওকে বুঝিয়ে দেওয়া যায়, হিরণ ভেবে পাচ্ছিল না। তমালিকা এরই মধ্যে দু’বার চোখের ইশারা করেছে, জেনে নাও, ক’দিনের জন্য এসে উঠেছে। হিরণ মরিয়া হয়েই বলল, ‘দ্যাখ দূর্বা, এতদিন পরে তোকে দেখে খুবই ভাল লাগল। কিন্তু একটা ব্যাপার কী জানিস! আমার তো একটা পজিশন আছে, যদি জানাজানি হয়ে যায় যে তুই একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটিয়ে জেল খেটেছিস, সেটা কি আমার পক্ষে সম্মানের হবে? ডোন্ট মিসআান্ডারস্ট্যান্ড, তোর এখানে বেশি দিন থাকাটা বোধহয়...

       দূর্বা খাওয়া থামিয়ে হিরণকে দেখল। তারপর বলল, ‘এখন মনে হয় গাড়িঘোড়া কিছুই পাব না, তুমি ভেব না, ভোরবেলায়ই আমি চলে যাব। আমি এ ব্যাপারটা একদম ভাবিনি। ইউ আর রাইট...’

        দূর্বা থালার উপর জল ঢেলে দিল। বলল, ‘আর কিছু বলবে হিনুদা?’

      হিরণ বলল, ‘রাগ করলি? আমার কথাটা একটু তলিয়ে ভাবিস। আচ্ছা দূর্বা, বল তো, তুই এরকম একটা কাজ করতে গেলি কেন? মার্ডারটা করবার আগে তোর ফ্যামিলির কথা, মাসিমার কথা মনে পড়ল না?’

      দূর্বার চোখে একটা নীলাভ বিষণ্ণতা— যা বেদনারই ছায়াসঙ্গী— ফুটে উঠল। তমালিকা একটা অজানা আশঙ্কায় তাকিয়ে রইল দূর্বার দিকে, এবার হয়তো একটা অভাবিত প্রতিক্রিয়া ছুটে আসবে তাদের দিকে।

       দূর্বার চোখের সামনে তখন তার শৈশব কৈশোর প্রথম যৌবনের খণ্ড খণ্ড দিনের ছবি দোল খাচ্ছ, ঝড়ের মুখে বাবুইপাখির বাসার মতো।

      মফসসলের একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম... দক্ষিণ দিকে একটা নদী কষ্টেসৃষ্টে বয়ে চলেছে... কাছাকাছি দু’টো বাড়ি... একটা বাড়িতে তারা দু’ভাই— বিল্বদল আর দূর্বাদল... অন্য বাড়িটায় হিরণ, হিরণের বোন হেনা... দু-বাড়ির মধ্যে গভীর সদ্ভাব... ভোরবেলায় বাবা রমাপতিবাবু ট্রেন ধরবার জন্য বেরিয়ে যাচ্ছেন— শ্যামবাজারে ওঁর একটা বড় ওষুধের দোকান... দূর্বা আর হেনা তখন রাস্তার ধারে শিউলি কুড়োচ্ছে… রমাপতিবাবু দূর্বার চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বললেন, মাথায় মাফলার দাওনি কেন? নতুন ঠাণ্ডা পড়েছে।             হেনা, বাড়ি গিয়ে পড়তে বোস্…।’ ফুলের ভাগ নিয়ে তুমুল আঁচড়াআঁচড়ি...।

হেনা যখন ক্লাস টেন-এ উঠল, দূর্বা তখন ফার্স্ট ইয়ার-এ। হিরণদা বছর দুয়েক হল বি.এসসি পাস করে চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হেনার মা একদিন হেনাকে বললেন, ‘বড় হয়েছ, এখন ওই দূর্বার সাইকেলে বসে টইটই করে ঘোরাটা বন্ধ করো। যখন ছোটো ছিলে, কিছু বলিনি। পাড়াগাঁ… বিয়ে-থা দিতে হবে না!’

       কথাটা শুনে হেনার মনের ভিতর একটা লাল টকটকে রাগের কুণ্ডলী আস্তে আস্তে ফিকে গোলাপি অভিমানে রূপান্তরিত হয়ে গেল। তারপর সেই গোলাপি অভিমানটুকু জমাট জেদের মতো তার বুকের ভিতর জাঁকিয়ে বসে বলল: তোর মরণ যদি দূর্বার হাতেই হয় তো হোক্‌!

    এরই মধ্যে একদিন কলকাতা থেকে ফিরবার পথে ট্রেনের মধ্যেই রমাপতিবাবু অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।

     ডাক্তার বললেন, ‘স্ট্রোকই, তবে মাইল্ড। ভয়ের কিছু নেই ভাপাতত। ভিড়ের ট্রেনের এই লং জার্নিটা অ্যাভয়েড করতে পারলে ভাল, নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে।’

     তার পরের মাসেই হেনারা গ্রামের বাড়ি ছেড়ে সইয়ে শ্যামবাজারের ভাড়াবাড়িতে চলে গেল। প্রতিবেশী তারক ভট্টাচার্যর উপর রইল বাড়ি দেখাশোনার ভার। আগের মতো নিত্যদিন দেখা না হলেও দূর্বার সঙ্গে হেনার যোগাযোগটা ছিন্ন হয়নি অনেকদিন। দূর্বা অনেককিছু হেনাকে বলতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। তবে সেই বাঁচা-মরার সন্ধিক্ষণে শুধু হেনার মুখটাই তার মানে পড়েছিল বললেও কেউ আজ বিশ্বাস করবে?

      হিরণরা বহু দিন গ্রামছাড়া। সত্যিমিথ্যেয় রঞ্জিত হয়ে নানাভাবে ঘটনাটা তাদের কানে এসেছে। মনে করতে ভাল লাগে না, তবুও কিছুটা স্বীকারোক্তির মতো, খানিকটা সত্য প্রকাশের দায়বদ্ধতায় আরও একবার সেই সন্ধ্যাটাকে অনর্গল করে দিল দূর্বা।

 

টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল, সঙ্গে দমকা হাওয়াও ছিল। নিদিষ্ট সময়ের কিছু আগেই সন্ধ্যা নেমেছিল সেদিন।

       সেই সময় কাননদি এসে দূর্বার বাবা সনৎবাবুর পায়ের উপর আছড়ে পড়ে বলল, ‘মেসোমশাই, আমার টুনিকে ওরা ধরে নিয়ে গেল! আমি এখন কী করব?’ বলে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল।

       সনৎবাবুর অনেক বয়স হয়েছে, আগের মতো প্রভাবপ্রতিপত্তিও নেই— তিনি বললেন, ‘বিল্ব-দূর্বা, যদি কিছু পারিস কর। মেয়েটাকে বাঁচা!’

       কাননদি ওই ছোট্ট টুনিকে নিয়ে বিধবা হয়েছিল। এবাড়ি-ওবাড়ি রান্নার কাজ, সেলাই, কাগজের ঠোঙা বানিয়ে কোনওক্রমে বেঁচে ছিল মা ও মেয়ে। দূর্বার মায়ের অগাধ স্নেহ ছিল কাননের উপর। আপদে-বিপদে তিনিই ছিলেন কাননের বড় আশ্রয়। টুনির বয়স তখন চোদ্দ-পনেরো, কাজলা গার্লস ইস্কুলে ক্লাস এইটে পড়ছে।

 

চার

 

আবহমানকাল ধরেই পার্বতীপুর শান্ত ঝিমধরা আর পাঁচটা গ্রামের মতোই ছিল! হঠাৎ ক’বছরের মধ্যে সেই পার্বতীপুর যেন জেগে উঠল!

         পুরনো রাস্তার উপর থেকে যানবাহনের চাপ কমাবার জন্য পুরন্দরপুর থেকে একটা নতুন রাস্তা পার্বতীপুরকে দু’ভাগ করে বর্ডার ছুঁয়ে সোজা নর্থ বেঙ্গলের দিকে চলে যেতেই গা-ঝাড়া দিল পার্বতীপুর সহ গোটা এলাকাটা। নতুন নতুন বাড়িঘর ধাবা পেট্রল পাম্প গজিয়ে উঠে জায়গাটার চরিত্রটাই পালটে দিল! হু হু করে বাড়তে লাগল জমির দাম। সারাদিন নতুন রাস্তা দিয়ে অগুনতি লরি মাল নিয়ে যাওয়া-আসা করতে লাগল। নতুন নতুন লোকে অঞ্চলটা ভর গেল রাতারাতি।

       এরই পাশাপাশি অবধারিতভাবে ডিজেলকালু বলে একটি ছেলে তার দলবল নিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল! দাঁড় করানো লরি থেকে ডিজেল চুরি করা দিয়েই তার উত্থান ঘটেছিল। আস্তে আস্তে খুন ডাকাতি ছিনতাই জুলুম করে টাকা আদায়ের পাশাপাশি মেয়ে-বউদের বিরক্ত করা তো ছিলই, এক সময় বেপরোয়া হয়ে গরিব ঘরের মেয়েদের উপর চরম অত্যাচারও শুরু করে দিল কালুর দলবল।

      এলাকায় যারা রাজনীতি করত, তদেরও দমিয়ে ফেলল ডিজেলকালু। সমর পাল দয়াল নন্দী মোহন মিত্তির— তিন দলের তিন নেতাই চুপসে গিয়ে মুখ বন্ধ করে রইল। এলাকার এমএলএ আবার তিন দলের বাইরে চতুর্থ দলের। দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে একদা দল থেকে বিতাড়িত— নিজের ক্যারিশমায় জিতে গিয়েছেন। পার্বতীপুর সংলগ্ন এলাকায় তেমন ভোটভিত্তিও নেই, তিনি দূরে বসে ব্যাপারটা উপভোগ করতে লাগলেন। পাল নন্দী মিত্তির— তিন নেতাকেই কালু আলাদা করে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ‘কোন শালা পুটকিবাজি করলে পেছনে চাকু ঢুকিয়ে ঘুরিয়ে দেব।’

       পার্বতীপুরের পাশের গ্রাম কাঁটাখালির একটা পোড়োবাড়িতে ডিজেলকালুর রাজধানী।

     রাত আটটা নাগাদ তিন-চারজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে দূর্বা যখন কাঁটাখালি পৌঁছল, ডিজেলকালুর দলের তিন-চারজন তখন ঘরের মেঝেতে বস মদ খাচ্ছে। ঘরের বাইরে দুটো বাইক দাঁড় করানো। টুনি ঘরের এক কোণে দু’হাঁটুর উপর মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তখনও মহাসর্বনাশ হয়নি বোধহয়য়, দূর্বাকে দেখেই ‘মামা!’ বলে দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল।

       ওরা কিছু বলল না, জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে দেখল দূর্বার চলে যাওয়া।

      বাজারের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছেছে, এমন সময় দু’টো বাইকে কালুর দল এসে দূর্বার পথ আটকাল। মুহুর্তের মধ্য ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে দূর্বা চিৎকার

করল, টুনি, পল্টুমামার সঙ্গে দৌড়ো— দৌড়ে পালা! দূর্বাও উল্টোদিকে ছুট লাগাল, বাইক থেকে নেমে দু’জন দূর্বার পিছনে ছুটল। খানিকটা দৌড়নোর পরে, যখন ওরা দূর্বাকে প্রায় ধরে ফেলেছে, সামনে ইব্রাহিমচাচার মাংসের দোকান দেখতে পেয়ে তার ভিতর ঢুকে পড়ল দূর্বা।

       ছোটো দোকান, পেছনোর পথ নেই— কালুর হাতে উদ্যত ওয়ান শটার— মাংস কাটার উঁচু চাতালটার উপর দূর্বাকে চিত করে ঠেসে ধরেছে কালু— কালুর সঙ্গী বলছে, ‘কানের নীচে, কানের নীচে ঠেকিয়ে মার। শালা, কচি মালটাকে ভোগে লাগাতে দিল না। নিজে খাবে— জন্মের মতো খাওয়াবো আজ হারামিকে। নেতাগিরি মাড়ানো বের করে দে। ঘোড়া টান—

         চাতালের উপর দূর্বার ডান হাতটা বাঁচার মতো একটু খড়কুটো খুঁজছিল… মাংস কাটবার ভারী একটা চোপার হাতে ঠেকল… ঠান্ডা বহুস্নাত নির্মম চোপার… চোখের পলকে এক ঝটকায় একটু সোজা হয়ে দূর্বা সেই চপারটা একটু বেঁকিয়ে বসিয়ে দিল কালুর বাঁ কাঁধের উপর… একটা লাথি মারতেই কালু দোকানের বাইরে ধুপ করে ছিটকে পড়ল। তারপর আর ওঠেনি কালু।

         দূর্বার শরীরটা একটু কাঁপছে। তমালিকা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে দু’চোখ বুজিয়ে ফেলল।

      হিরণ বলল, ‘এটা এত সরাসরি না করে অন্যভাবেও করা যেত না? একটু বুদ্ধি খাটিয়ে, ডিপ্লোম্যাটিক ওয়েতে? এদেরকে খুব ট্যাকটফুলি ট্যাকল্‌ করতে হয়। সঙ্গে পাবলিক সাপোর্ট রাখতে হয়। মার্ডার কোনওদিন সলিউশন হতে পারে?’

        দূর্বা বলল, ‘টুনিকে সেদিন বাঁচানোটা বা আমার বেঁচে থাকাটা ঠিক ডিপ্লোম্যাটিক ওয়েতে হয়নি, বলতে চাও?’

        হিরণ একটু দমে গিয়ে বলল, ‘না, ঠিক তা বলছি না, পৃথিবীতে কত ক্রাইমই তো ঘটছে, আমরা কি তার সব কটার প্রতিকার করতে পারি? কাজেই… তোর উচিত ছিল, প্রথমেই পুলিশে খবর দেওয়া।’

       দূর্বা অবাক হয়ে বলল, ‘ওই দুর্যোগের মধ্যে এগারো কিলোমিটার দূরের থানায় খবর দেওয়া… ধরে নিলাম, পুলিশ আসত, খবর পেয়েই আসত, টুনিকে অক্ষত পেতাম? কাননদিকে মুখ দেখাতে পারতাম? আমার যা হল, তার জন্য একটুও আফসোস নেই। কেন নেই, জানো হিনুদা? কারণ আমার বিরুদ্ধে পুলিশ একটা সাক্ষীও জোগাড় করতে পারেনি। ইব্রাহিমচাচাকে খুব চেষ্টা করেছিল ম্যানেজ করার, পারেনি। যেদিন খালাস পেলাম, শ’য়ে শ’য়ে মেয়েরা কোর্টে হাজির হয়েছিল। ওই দিনের পর কালুর দলটা রাতারাতি ভ্যানিশ হয়ে গেছিল।’

         হিরণ হালকা ব্যঙ্গ করল, ‘তুই তো তাহলে ওখানে রীতিমতো হিরো কি বলিস?’

         দূর্বা বলল, ‘হিরো কি না জানি না, তবে একটুও অনুতপ্ত নই।’

 

ঘর পুরো অন্ধকার, কিন্তু দূর্বার ঘুম আসছিল না। অনেকদিন পরে আবার সেই দুঃসহ যন্ত্রণা তার স্নায়ুপুঞ্জকে টানটান করে রাখছিল।

       বিয়ের আগে পর্যন্ত এই ঘরটা বোধহয় হেনারই ছিল। দেওয়ালে তার অল্পবয়সের একটা ফটো, বিকেলবেলায় দেখেছে, দেওয়াল আলমারির ভিতর

কয়েকটা পল্-সায়েন্সের বই, একটা শুকিয়ে যাওয়া নেলপালিশের শিশি, মরচেধরা সেফটিপিন। হিরণের বিয়ে হয়েছিল ভাড়াবাড়িতে থাকতে, এ ঘরের দেওয়ালে তবু শুকনো বসুধারার বিবর্ণ মলিন চিহ্ন দূর্বাদলকে এক নির্ঘুম শেবরাত্রির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

       জেলকাস্টডিতে থাকবার সমর সে হেনার একটা ছোটো চিঠি পেয়েছিল : ‘ভাবলেও লজ্জাঘৃণায় মনটা অবশ হয়ে আসে— একটা খুনির সঙ্গে আমার

সম্পর্ক ছিল! যার সঙ্গে সারা জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিলাম, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু যাকে দিয়েছিলাম সে মানুষ খুন করে জেল খাটছে! ছাড়া পাওয়ার পর কেউ যেন কোনও দাবি নিয়ে এসে আমার সামনে না দাঁড়ায়, এইটুকু দয়া করলে বাধিত হব।’ চিঠিটা আজও দূর্বার পার্সের ভিতরে আছে।

 

বিছানায় শুয়ে হিরণ তমালিকাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি দূর্বার সব কথা বিশ্বাস করলে?’

          তমালিকা বলল, ‘অবিশ্বাসের কী আছে? মানুষ বাঁচতে এবং কারওকে বাঁচাতে গেলে এরকমই করে। সবাই তো আর হিসাব কষে সব দান চালতে পারে না।’

        হিরণের ডান হাত তমালিকার শরীর পরিক্রমা করছিল। সে চাইছিল, তমালিকা সাড়া দিক। তমালিকা সাড়া দিচ্ছিল না। খাওয়ার টেবিলে হিরণ

তো আভাসে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে, এভাবে নিজের জীবনটা নষ্ট করা উচিত হয়নি দূর্বার। তমালিকার দু’চোখে মুনের মুখটা ভেসে উঠল, খাটের পাশেই আলাদা একটা বেবিকটে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে মুন। টুনির জায়গায় যদি সেদিন মুন থাকত? যদি মুনকে কেউ ওভাবে ধরে নিয়ে যেত, কেউ যদি তখন তাকে বাঁচাতে এসে নিজেও বিপন্ন হত, হিরণ দূর্বাকে যা বলল আজ, তমালিকাও কি তাই বলত?

         বিতৃষ্ণায় মুখের ভিতরটা শুকিয়ে আসছিল, হিরণের তৃষ্ণার্ত ঠোঁট দু’টোকে প্রত্যাখ্যান করে সে বলল, ‘হাতটাকে বুকের উপর থেকে সরিয়ে নাও, ভালো লাগছে না!’

          হিরণ কামার্তস্বরে বলল, ‘ও তো বলেছ কাল সকালেই চলে যাবে, তবুও তুমি সহজ হবে না?’

পাঁচ

 

অন্য দিন বেশি রাতে হিরণ মোবাইল বন্ধ করে রাখে, আজ এইসব কথাবার্তায় সেটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে।

        রাত প্রায় দুটো তখন, সেই সময় হিরণের মোবাইলে সেই অভিমানী সুরটা গুমরে উঠল! স্ক্রিনের নীলাভ পটভূমিতে হলুদ অক্ষরে হেনার নাম! রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতেই ওদিক থেকে হেনার আর্তস্বর ঝাঁপিয়ে পড়ল কানে, ‘দাদা, মুনকে সঙ্গে নিয়ে একটু আসবি? ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে ওকে, হয়তো আর কোনওদিন তোদের দেখতে পাব না। আমি আর পারছি না রে! যদি রাতটা কাটে দেখা হবে— তোদের জন্য অপেক্ষা করব, ছাড়ছি!’ হাহাকারের মতো শোনাল কথাগুলো।

        রাত্রির নৈঃশব্দের কল্যাণে তমালিকাও হেনার শুনতে পেল। বিছানায় উঠে বসে কতকটা আপন মনেই বলল, একটা মেয়ে তিলতিল করে মরার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা তাকে উপদেশ দিচ্ছি, সহ্য কর, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আজ যদি হেনা ওবাড়ি থেকে চলে আসে, সে আমাদের লায়াবিলিটি হয়ে উঠবে। আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য একটু কম হয়ে যাবে, সমাজে নানা কথা উঠবে, কত ভয় আমাদের, তাই না? ওঁর বুক পিঠে উরুতে পিছনে কত যে কালশিটের দাগ— আমি দেখেছি, তবুও ভেবেছি, সব ঠিক হয়ে যাবে!’ তমালিকার গলাটা ধরে এল।

        হিরণ তার মাথায় হাত রেখে বলল, ‘তমাল, ভেঙে পড়ো না, ভুল যখন করেই ফেলেছি, তার তো চারা নেই! এর জন্য দায়ী আমি আর ওই বাস্টার্ড কল্যাণ সেন!’

       তমালিকা বলল, ‘ওঘর থেকে দূর্বাকে ডেকে তুলে দোখো না, অসীমের ট্যাক্সিটা পাও কি না! পনেরো মিনিটেই লেকটাউন পৌঁছে যাবে।’

        হিরণ বলল, ‘এখন কি আর অসীম সোজা হয়ে স্টিয়ারিংয়ে বসতে পারবে? আর ঘণ্টাদেড়েক পরেই তো আলো ফুটবে…’

 

ভোরবেলায় হিরণ বেরিয়ে যাচ্ছে, তমালিকা বলল, ‘দূর্বাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে? সঙ্গে একজন থাকা ভাল।’

        হিরণ বলল, ‘নাহ, একেই দিনরাত দূর্বাকে জড়িয়ে বোনটাকে হ্যাটা করছে— প্রবীরকে তুলে নেব বাড়ি থেকে। জানি না, কী দেখব গিয়ে…।’

        তমালিকা বলল, ‘যা-ই দেখো, হেনাকে রেখে আসবে না ওখানে, সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।’

 

একটু বেলায় ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে দূর্বা বলল, ‘বউদি আমি এবার যাব। ঘুম থেকে উঠতে খুব দেরি হয়ে গেল, স্যরি।’

      তমালিকা বলল, ‘এখনই কী যাবে! তোমার দাদা লেকটাউন গেল— ফিরুক! ও না-ফেরা পর্যন্ত থেকে যাও, প্লিজ। মুনকেও বলে যাবে না?’

       দূর্বা মাথা নাড়ল, ‘অনেকটা সময়ই তো থাকলাম, খুব ভাল লাগল, তোমাদের ভুলব না।’

      দূর্বা সিঁড়ি দিয়ে নামছে, পিছনে তমালিকা। সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে দূর্বা যখন নিচু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধছে তমালিকা বলল, ‘একটা রিকোয়েস্ট করব, রাখবে?’

      তমালিকার চোখে এখন আর কালকের সেই বিরক্তি অপ্রসন্নতা নেই, তার মুখখানা এমনিতেই সুন্দর, কাঠিন্য থেকে কোমলতায় পৌঁছে সে আরও কমনীয় হয়ে উঠেছে।

      দূর্বা মুখ তুলে তাকাতে তমালিকা বলল, ‘আজ হোক, কাল হোক, হেনা এখানে চলে আসবে। তাকে বলব, নিষ্ঠুর অমানুষ বা স্বার্থপর কাপুরুষের চেয়ে জেন্যারাস্‌ মার্ডারার বেশি অনেস্ট! হেনা আমার কথা অবিশ্বাস করবে না— তুমি অভিমান পুষে রাখবে না, কথা দাও।’

       বাইরের সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে দূর্বা বলল, ‘বউদি, তোমার ননদাই তো হিনুদার এক এম.ডি-র শালা, তাই না?’

       তমালিকা মাথা নীচু করে বলল, ‘হ্যাঁ, কল্যাণ সেন, গত বছর রিটায়ার করেছেন।’

       দূর্বা বলল, ‘উনিই তো ওঁর শালা পার্থর সঙ্গে হেনার বিয়ের প্রপোজালটা দিয়েছিলেন, হিনুদা সেটা অয়াকসেপ্ট করেছিল। তাই না?’

        তমালিকা নীরব।

       দূর্বা যেন আপনমনেই বলল, ‘শ্যালকের শ্যালকের উপর ওঁর একটা কর্তব্যও ছিল, ভদ্রলোককে ভালই বলতে হবে। হিনুদাকে উনি ঠকাননি। বরাবরই দেখেছি লুডো খেলতে বসলে হেনার পাকা ঘুঁটি সবসময় সবচেয়ে বড়ো সাপটার মুখেই পড়ত! এ খেলাটাও তেমনই ছিল... হিনুদার

ঘুঁটি পড়েছিল মইয়ের গোড়ায়, আর হেনার ঘুঁটি… তোমাদের আর দোষ কী...’

        তমালিকা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আঁচলের কোণ কামড়ে ধরে নিঃশব্দে পুড়ে যাচ্ছে…।

1111-removebg-preview.png

গল্পের বই উপহার পেতে কে না চায়!
এখনই Subscribe  করুন,
আর পেয়ে যান আপনার প্রথম বইটির মূদ্রিত মূল্যের ওপর ২৫% ছাড় 

Thanks for being our family!

  • Youtube
  • pngwing.com
  • 1111
  • tumblr
  • Instagram LOGO PNG2

+91 8240333741

Magic Seeds Books LLP

119 Abhay Patuli Lane, Shuksanatantala, Chandannagar 712136

Email us at: manikarnika.pub@gmail.com

For any other queries feel free to reach us at: 8240333741(Call/Whatsapp)

©2022 by Manikarnika Prakashani.

bottom of page