শরৎ হয়ে এলে ফিরে
তবু এখনও ছায়ারা বড়ো হয় বিকেল হলে। এমনকি এই মধ্য-শরতেও। বেলেমাটি নয়, গন্ধকের গুঁড়োর ভিতর থেকে, শিকড়ে বীজসূ ভূগোলকের মুগ্ধতা নিয়ে, বহুপর্ণী অ্যাকেসিয়ারা বেড়ে ওঠে উৎসব মাখা এই ছায়াদ্বীপে। এ এক মায়ামৃগকাল যেন— সংকটের অবসান; চারিদিকে আশ্বিনের গোপন আলো ভেসে বেড়ায়— সম্ভ্রান্ত আকাশ যেন অপেক্ষমাণ থাকে। পুরোনো আলোর গন্ধমাখা সময়ের আবডালে লুকিয়ে থাকা অকালবোধনের শীত-ঋতু, ছন্দময় উপস্থিতি আজকের মানুষের কাছে এক ধরনের শ্রুতিবিশোধন। বিগত-শরতের আকাশ তখন শস্যাভ সুসময় হয়ে নেমে আসে আজকের এই নগণ্য নগরীদের বুকে। অনুযাপন-সম উজ্জ্বল তাদের বৈভব, এক-এককেকটি অন্তর্ধান বিন্দু। যা কিছু জীর্ণ, মলিন— যায়, শরৎ আসে।
আসে পুজো। পুজো আসে বইয়ের পাতায়, নতুন গল্পের গন্ধ বয়ে। পুজো আসে রোদের রং বদলের খবর নিয়ে। সেই পুজোকেই খুঁজি আমরা যা এনে দেয় হাওয়াবদল। বিজ্ঞাপনের বাদ্যে নয়, সংবাদ মাধ্যমের বিপণনে নয়, এমনকি ক্যালেন্ডারের অঙ্গুলিনির্দেশেও নয়— পুজো আসে তার নিজের সময়ে— কোপাইয়ের তীরে বসে থাকা বাউলের নির্লিপ্ত সুরে কিংবা সোনাঝুরির খোয়াই বাতাসের প্রেমালাপে; হয়তো তখনও গাওয়া হয়নি বর্ষাবিদায়— হয়তো কখনও লক্ষ্মীপুজোর তিথিপার করে বেলাশেষে এসে হাজির হয় দীপাবলির ঠিক আগে। আসলে সাদা মেঘের দম্ভ মেখে আলসে বেড়ালের মতো পাঁচিলের উপর শুয়ে থাকে ওই যে কাঁচা হলুদ রোদ— সেই তো পুজোর বাহন— দোলা, ঘোটক— ওসব একেবারে বানানো গল্প।
বরং সঙ্গে বাহন হিসেবে আসে পুজোর ছবি। অবশ্য ঠিক কাকে বলে ‘পুজোর ছবি’¾ তা নিয়ে প্রতর্ক চলতেই পারে। সেভাবে সংজ্ঞা-নির্ধারণ সত্যই কঠিন। উৎসবের শরীরে এক বহুমাত্রা ধরা থাকে সবসময়ই। আদিগন্ত জুড়ে বাঙালির স্মৃতির পর্দায় একের পর এক ছায়াছবি— কোথাও পুজোর প্রত্যক্ষ উদযাপন, কোথাও বা তার উপস্থিতি কাহিনির প্রেক্ষাপট রূপে। সত্যি বলতে পুজোর সঙ্গে পুজোর ছবির অনুষঙ্গ এতই নিবিড় যে বহু বাণিজ্যিক ছবি প্রতি বছর দুর্গোৎসবকেই করে তোলে বিপণনের কেন্দ্রবিন্দু। তবে সেসব ছবি আপাতত সরিয়ে রেখে আমরা ফিরে দেখব এমন কিছু চলচ্চিত্র— পুজো এলেই কোনো না কোনো ভাবে যারা চলতে থাকে মাথার ভিতরে।
পুজো বলতে প্রথমেই মনে আসে নীল সাদা আকাশের নীচে সাদা কাশের হিল্লোল, আর চকিতে চোখে ভেসে ওঠে দুটি বালক-বালিকার ছুটে যাওয়া কাশ আর আকাশ মিশে যাওয়া এক সুদূর প্রান্তরে; দিকচক্রবালে অচিনপুরের খবর আনা প্রথম রেল। সেই মুহূর্তই কি হয়ে ওঠে না মহালয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ? ‘পথের পাঁচালি’র অন্য দৃশ্যেও দুর্গাপুজো আছে, তবে সেখানেও রেলগাড়ির মতোই দেবীপ্রতিমাকে আমরা দেখি প্রধানত অপরের চোখের আলোয়—ঢাকিদের বাজনায়, ছোটোদের উন্মুখ ছুটে যাওয়ায়, মা-র প্রশ্রয়মাখা হাসিতে, সবার সঙ্গে প্রসাদ ভাগ করে নেওয়ার আনন্দে। প্রকৃতপক্ষে পঞ্চভূতই যেন হয়ে ওঠে এক বিপুল দর্পণ যেখানে একাধারে প্রতিবিম্বিত হয় আমাদের সকলের অমল শৈশব, পুজোমাখা শারদ আলোয়।
এভাবেই সত্যজিতের অন্যান্য ছবিতেও পুজো আসে অন্য চরিত্রে ব্যাপ্ত হয়ে। ফলত ‘নেই পুজো’ও হয়ে ওঠে ‘আছে পুজো’র ছবি। সেই যখন ‘সোনার কেল্লা’য় হাওড়া ষ্টেশন থেকে ছেড়ে যাছে ট্রেন, ফেলুদা আর তোপসের উজ্জ্বল চোখের তারায় যাত্রা শুরুর খুশি, তখন, ঠিক তখনই বেজে ওঠা বিখ্যাত ফেলুদা থিম মনের মধ্যে হয়ে ওঠে না কি পুজো শুরুর ঢাক-বাদ্যি? কিংবা ‘আগন্তুক’ ছবিটির কথা যদি ভাবি— পুজোর কোনো দৃশ্য সেখানে নেই, কিন্তু উল্লেখ আছে। আর সেই পুজো-আবহে ‘অচেনা’ আগন্তুকের আসা ও তাঁর ‘চেনা’ অতিথি রূপে ফিরে যাওয়া— একেও কি এক সাবেকি অর্থে করে তোলে না পুজোর ছবি? রূপসাগরে ডুব দিয়ে অরূপরতনের খোঁজে ফেরা বোহেমিয়ান ‘সিনেফিল’ মন, ‘সভ্য’-ও-‘অসভ্য’-র দ্বন্দ্বের মাঝে, এক পরাবাস্তব বাইসনের তিতীর্ষু, পিঙ্গল ও প্রাগৈতিহাসিক চিত্রকল্পকে আবিষ্কার করে কলকাতা নামক এক উপদ্বীপের ম্যারাপ বাঁধা পুজো-প্রস্তুতির প্রথাগত প্রেক্ষাপটে— ঠিক তখনই নেপথ্যে বেজে ওঠে এক তমোঘ্ন বীণার সুর— ‘কাহার’—সে অনুভব অলৌকিক। সকলেরই আছে ব্যক্তিগত ঈশ্বরীর খোঁজ।
‘নায়ক’ ছবিতে প্রতিমা-বিসর্জনের দৃশ্য জীবনের নশ্বরতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় নায়ক অরিন্দমকে— একটি আকস্মিক মৃত্যুকে সাক্ষী করে, একই সঙ্গে পুরোনো অরিন্দমেরও কি মৃত্যু ঘটে না? ‘একটাই লাইফটাইম, একটাই চান্স’—এই উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করদার চিতার আগুনে সে বিসর্জন দেয় সাবেকি মূল্যবোধ, পুরোনো গ্রন্থি ছিঁড়ে সে যাত্রা শুরু করে—মহা-নায়কোচিত উত্থানের সিঁড়ি বেয়ে।
ঋত্বিক ঘটকের নানা ছবিতেও পুজোর উপস্থিতি স্বকীয়তায় ভরা। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় নীতা যখন প্রথম টের পায় তার শরীরে মারণব্যধির থাবা, সেই ত্রস্ত অসহায় মুহূর্ত জুড়ে বেজে ওঠে মেনকার আকুল আহ্বান— ‘আয় গো উমা কোলে লই’— আগমনীর সঙ্গে বিজয়ার সুর এভাবে মিলেমিশে একাকার হতে আগে কখনও শুনেছি কি আমরা? ছবির শেষে হিমালয়ের কোলেই নীতার অন্তিম আশ্রয় যেন গিরিতনয়ার ঘরে ফেরার ঈঙ্গিত বয়ে আনে। আবার ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’য় দেবীর আবাহন ঘটে ছৌনাচের মধ্য দিয়ে। দেবী সেখানে ধূলিধূসরিত মানবীরই অন্য মুখ। পটুয়ার কাছে তিনি লৌকিক মা। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের দেবিস্তোত্র থামিয়ে দিয়ে সে বলে— ‘তোমার এই অং বং বন্ধ রাখো দেখি।’ তারপর দেবীর মুখোশের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে সদর্পে বলে, ‘আমার মা। ঘরের মা।’ জ্ঞানী যখন দেবীকে বলে ‘পঞ্চভূতে ব্যাপিকা শক্তি’, সে নিঃসংশয়ে বলে, ‘শক্তি-ফক্তি বুঝি নাই। মা।’ তার্কিক যখন পুরাণের তত্ত্বকথা শোনাতে চায় সে বলে, ‘পুরাণ-টুরাণ কী? নূতন। মা আবার পুরাণ হল কবে?’ এমন অপরূপ দেবীবন্দনা ঋত্বিক ঘটকের হাতেই সম্ভব।
অনেক ছবিতে আবার পুজোই কাহিনির অন্যতম চরিত্র হয়ে উঠেছে। যেমন ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। প্রতিমা নির্মাণের স্তরে স্তরে এখানে দানা বেধে ওঠে রহস্য। বহুমূল্য গণেশমূর্তির অন্তর্ধান, মগনলালের হাতে লালমোহনবাবুর লাঞ্ছনা এবং সবশেষে বৃদ্ধ প্রতিমা শিল্পীর হত্যা ফেলুদার উপস্থিতির ঔজ্জ্বল্যকেও যেন সাময়িক রাহুগ্রস্ত করে রাখে। অবশেষে ফেলুদার হাতে মগনলালের পরাজয়ের মুহূর্তে যখন নির্ভুল লক্ষে ছুটে যাচ্ছে একটার পর একটা গুলি, পর্দা জুড়ে গমগম করছে— ‘যারা গুন্ডা দিয়ে নিরীহ লোককে খুন করায়, যারা টাকার লোভে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে তার টাকা দিয়ে রেহাই পাবে না...’ সেই কি নয় অসুরনিধনের মাহেন্দ্রক্ষণ? লক্ষণীয়, সেদিন বিজয়া দশমী। বিসর্জন অবশ্য ঘটে মগনলালের— তাই বিনির্মাণের এ এক অপূর্ব সন্দর্ভও বটে। অতএব, শিশুকাল থেকে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ হয়ে ওঠে পুজোর ছবির রাজা।
মন্ত্রী বলতে মনে পড়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘হীরের আংটি’। ছবির শুরুতে রেডিওতে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র বহুপরিচিত সুর এক নিমেষে সৃজন করে মহালয়ার ভোর। নির্মীয়মাণ প্রতিমার সামনে মৃৎশিল্পী ও হাবুলের আলাপচারিতায় সত্যজিতের স্পষ্ট প্রভাব। এই ছবিতেও দৃশ্যের পর দৃশ্য জুড়ে শরতের অপূর্ব প্রকৃতি আবিষ্ট করে রাখে। এখানেও আছে রহস্য, অপরাধ এবং প্রতারণার চক্রান্ত। আছে ষষ্ঠীর মতো মজাদার চোর, পাঁচুর মতো অনুগত ভৃত্য, হাবুল আর তিন্নির মতো দুটি অমল বালক-বালিকা, আর আছে রহস্যময় গন্ধর্বকুমার আর তার সাগরেদ শ্বেত ও লোহিত। কিন্তু শেষ অবধি ভালো মানুষদের জিতে যাওয়া এবং ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের সম্মিলিত পুজোর অঞ্জলিদানে এটি হয়ে ওঠে এক অপরূপ স্বপ্নপূরণের গল্প। গোটা ছবি জুড়ে আগমনীর সুর আর শেষে সম্মিলিত প্রসাদপ্রাপ্তির দৃশ্যে বৃত্তসম্পূরণ— পুজোর ছবি হিসেবে এটিকে বড়ো প্রিয় করে তোলে। সাম্প্রতিককালে আর-একটি ছবিতেও পুজোর উদযাপন চমৎকার লাগে, সেটি ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’। এখানেও কাহিনির পরতে পরতে দুর্গাপূজার উপস্থিতি। আগমনী থেকে বিজয়া জুড়ে গানে গানে ছড়িয়ে থাকে গুপ্তধনের সঙ্কেত আর দেবীর চালচিত্রে লুকিয়ে থাকে গোপন মানচিত্রটি। তিনটি ঝকঝকে তরুণ-তরুণীকে নিয়ে তৈরি এই দ্বিতীয় ছবিতে নয়নলোভন শরতের রূপ ছোটবেলায় পড়া পূজাবার্ষিকীর সুঘ্রাণ মনে আনে। বাংলাছবি না হলেও একটি ছবিতে পুজোর অনুষঙ্গ সুপ্রযুক্ত মনে হয়, সেটি ‘কাহানী’। সিনেমাটির নানা দৃশ্যে বারবার উঁকি দেয় পুজোমুখর কোলকাতা। তবে শুধু সেই কারণে একে পুজোর ছবি বলছি না। এই কাহিনির অন্তিমপর্বে দশমীর অপরাহ্ণে একা একটি মেয়ের প্রবল প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে অশুভশক্তির বিনাশ অসুরদলনী দেবীর কথাই মনে করায়। অন্য কোনো উৎসবের আবহে এই এফেক্ট তৈরি হতো না।
এছাড়াও আছে এমন অনেক ছবি যেখানে পুজোকে ব্যবহার করা হয়েছে কাহিনির প্রেক্ষাপটে। মূল ঘটনা-পরম্পরার সঙ্গে তার সম্পর্ক আধার ও আধেয়ের। যেমন ধরা যাক অপর্ণা সেনের ‘পরমা’। এখানে দেবীবরণের মধ্যে দিয়ে পরমা চরিত্রটির উপস্থাপনা তার কল্যাণময়ী গৃহলক্ষ্মীরূপটির পরিচয় আনে। কিন্তু কাহিনির ক্রমোন্মচনের সঙ্গে সঙ্গে তার চরিত্রেও ঘটতে থাকে বিবর্তন। তার স্বাতন্ত্রকামী আত্মার নবজাগরণ ঘটে অপ্রত্যাশিত প্রেমের হাত ধরে। তার আত্মানুসন্ধান এ ছবিকে করে তোলে নারীবাদের দর্পণ। কোথাও কি দেবীর বহুধাবিভক্ত রূপরাশির বার্তাই বয়ে আনে না এই আত্মবিনাশে উদ্যত নারীর নিজের সঙ্গে বাঁচতে শেখার অন্তিম লড়াই? ঋতুপর্ণের ‘উৎসব’ জুড়েও পুজো মিশে থাকে কাহিনির অঙ্গে অঙ্গে। যদিও এটি মূলত পারিবারিক পুনর্মিলনের ছবি, তবু দুর্গোৎসবকে ঘিরেই তা আবর্তিত। প্রায় প্রতিটি চরিত্রের নিজস্ব সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নীরব শ্রোতা হয়ে জেগে থাকে একচালার সাবেকী প্রতিমা। তারপর, অনেক টুকরো টুকরো বলা ও না বলা কথার চূর্ণ ছড়িয়ে সকলেই যখন ফিরে যায় স্বভূমে, পড়ে থাকে শূন্য নাটমণ্ডপে সন্ধ্যাদীপের আলোআঁধারী। বিসর্জনের শোভাযাত্রার আলোর নরম কৌলীন্যে মিশে যায় দুটি শরীরের অরূপ-আবাহনের স্মরণীয় সংলাপ:
‘বেসিক এলিমেন্টটা তো এক। খড় আর বাঁশটা বাদ দিলে বাকি থাকে জল আর মাটি, সেই জল আর মাটি দিয়ে ঠাকুর গড়ে, আবার ভাসান দিলে জল আর মাটি হয়ে যায়। কন্সট্রাকশন, ডিকন্সট্রাকশন, কন্সট্রাকশন, ডিকন্সট্রাকশন...’
এভাবেই কিছু ছবিতে পুজো তৈরি করে ঘটনার প্রেক্ষিত। যেমন ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ কিংবা পরবর্তী কালে ‘জাতিস্মর’ ছবিতে পুজোর আবহেই জমে ওঠে কবির লড়াই এবং অবশেষে কাহিনির ট্র্যাজিক পরিসমাপ্তি। সত্যজিতের ‘দেবী’ চলচ্চিত্রটি আবার একদম অন্য এক পুজোর গল্প বলে যেখানে ভক্তই হয়ে ওঠে দেবীর নির্মাতা, আর এই আরোপিত দেবীনির্মাণের অভিঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় এক তরুণ দম্পতির সহজ মানবিক জীবনধারা। মন্দিরে দেবী-মানবীর দ্বৈত আলোকে শর্মিলা ঠাকুরের আত্মমগ্ন বসে থাকা, আর আবহে ঘুরে ঘুরে আসা শ্যামাসংগীতের সুর— ‘নূতন রূপে নূতন বেশে শ্যামা মায়ে দেখ এসে’— এ এক অন্যরকম দেবীবন্দনা। তবে শুরু থেকে শেষ অবধি অসংখ্যবার পুজো প্রসঙ্গ এলেও ঋতুপর্ণের ‘অন্তরমহল’কে পুজোর ছবি বলে ভাবতে পারি না। কারণ পুজো এখানে স্বমহিমাচ্যুত এবং দাম্ভিক জমিদারের রাজানুগ্রহ লাভের বিকৃত চেষ্টার উপলক্ষ মাত্র।
যে ছবিটির উল্লেখ আলাদা করে এই লেখায় না করলেই নয়, সেটি সাম্প্রতিক— ‘উমা’। এই চলচ্চিত্রের কাহিনি অবশ্য বাস্তব-অনুপ্রাণিত। কানাডার অন্টারিওতে অবস্থিত সেন্ট জর্জ শহরে বসবাসরত ইভান লিভারসেজের জীবন এই ছবির নেপথ্য। সাত বছর বয়সি লিভারসেজ ৬ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সালে এই পৃথিবী থেকে চলে যায়। এর বেশ কিছু মাস আগে থেকেই দূরারোগ্য রোগে ভুগতে থাকা এই শিশুটির মা, তার জন্য শেষ-বড়োদিন আয়োজন করেছিলেন আগেভাগেই— অক্টোবর মাসে— শহরের সব বাসিন্দাদের সমর্থন ও সাহায্যে। ‘উমা’-র পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় এই আশ্চর্য ঘটনা থেকেই ছবির অনুপ্রাণ সংগ্রহ করেন। ছবির বয়নে কিছু ত্রুটি সত্ত্বেও, এ এক অপরূপ অকালবোধনের ছবি। দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত বালিকার পুজো দেখার অন্তিম ইচ্ছাপূরণে এক পিতৃহৃদয়ের অতিলৌকিক লড়াই। ক্রমে ক্রমে এই অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রয়াসে সমবেত হয় আরও অনেক অনেক মুখ। এ যেন সকল দেবতার তেজ-রাশি সম্ভূতা মহাদেবী-সৃজনের এক সমান্তরাল কাহিনি। চরিত্রদের নামকরণেও তারই স্পষ্ট ঈঙ্গিত। উমা এখানে অসুরদলনী নয়, অসুখদলনী। তার হাতে প্রসাদের আশ্বাস, দৃষ্টিতে স্নিগ্ধতা, হাসিতে বরাভয়। আর সেই প্রসন্নহাসিনী বিমল বালিকার সামনে শেষ অবধি নতজানু হতে হয় আনন্দবিনাশী চিৎকৃত অহং-কারীকে। হোক বানানো পুজো, তবু এ পুজো জিতিয়ে দেয় বহু হেরে যাওয়া মানুষকে, ফিরিয়ে দেয় অনেক ছিঁড়ে যাওয়া গ্রন্থি। এ ছবির যাত্রা তাই অন্ধকার থেকে আলোর পথে, মৃত্যু থেকে অমৃতের পথে।
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ‘বিসর্জন’ একটি ভিন্নধারার ‘পুজোর ছবি’— যেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা ছবির অন্যতম কাহিনি। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন একটি বাংলাদেশি এলাকায় একজন চোরাকারবারি ভারতীয় মুসলমান নদীতে ভেসে আসে। নাম তার নাসির। তার প্রাণরক্ষা করে পদ্মা নামের এক হিন্দু বিধবা মহিলা। নিজের বাড়িতে নাসিরকে আশ্রয় দেয় পদ্মা। তাদের মধ্যে এক ‘ভিন্নধর্মী’ প্রেমের সম্পর্ক আর তার আপাত-পরিণতি, এই চলচ্চিত্রটির উপজীব্য। টানটান কাহিনি ও মুখ্য চরিত্রদের সাবলীল অভিনয় ছাড়াও, সামাজিক মূল্যবোধের চলমান দলিল হিসেবে এই ছবিটি তার যোগ্য স্বীকৃতি পায় ২০১৭ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়ে। দুবছর বাদে পরিচালক এর একটি সিক্যুয়েল বানিয়েছিলেন— ‘বিজয়া’ নামে। সেখানে এই ঘটনার ছবছর বাদের কাহিনির ছিন্ন সূত্রটি আবার তুলে নেন পরিচালক। পদ্মা আগের ছবির তৃতীয় মুখ্য চরিত্র গণেশ মণ্ডলের চিকিৎসার জন্য কলকাতায় এলে, নাসিরের সঙ্গে দেখা হয় তার। কাহিনি-বৃত্তটি শুধু সম্পূর্ণ হয় তা-ই নয়, মনে দাগ কেটে যায় এই দুটি ছবির মূল বক্তব্য— সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থিত মানুষের ভালোবাসার জয়গাথা। নামকরণের মুনশিয়ানায় পরিচালক সেই বার্তাটি যেন আরও অমোঘভাবে পৌঁছে দেন। ‘বিসর্জন’-এ উৎসবের শেষ নয়। কাহিনিরও নয়। ‘বিজয়া’-র সম্প্রীতিই উৎসবের অবলেশ।
এভাবেই অনেক, অনেক ছবির মুহূর্ত, আর তার ক্যানভাসে আরও, আরও উৎসবের না-হয়ে ওঠা উদযাপন জুড়ে থাকে আমাদের দিনগত আলো-ছায়াময় কারুবাসনায়— প্রতিপ্রত্যেক শরৎ তাতে যোগ করে অমেয় কিছু আলো। নতুনের অপেক্ষা আর পুরোনোকে ফিরে দেখা— এই নিয়ে আবর্তিত আমাদের ‘পুজো রেট্রসপেকসন’। প্রতিমার বিসর্জনে নদী অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে গ্রহণ করে তার অতীত পলি-জমা স্মৃতি। মণ্ডপে মণ্ডপে আকৈশোর বেজে চলা গানের সুরে সুরে তৈরি হতে থাকে আবহ। হাতের পাতায় নতুন গল্পের ভিতর থেকে উঁকি দিতে থাকে হারানো চরিত্রেরা। জানলার পাশে লাবনীলতায় জমতে থাকে কিছু বিচ্ছুরিত আয়ুষ্কাল। আশ্বিনের মাঝামাঝি, মনের মাঝে অমোঘ বাদ্যি বেজে ওঠে— রবি-ঠাকুরের মধু-বিধু তখন ছুট লাগায় সনৎ সিংহের পাঠশালা থেকে, ভূতের রাজার বরে হীরকের দরবারে সোনা ফলায় খুশির উৎসবে যোগ দিতে আসা দুই গায়ক-বাদক, রক্তকরবীর রাজা হাত লাগান চলচ্চিত্রের রাজ-মূর্তির গলায় পরানো রশিতে— ‘সব আমাদের জন্য’। সংকটকালে, শরৎ হয়ে ফিরে আসে শৈশবের বৈভব। আমরা জানি আমাদের আছে উদয়ন পণ্ডিত এক— তার কণ্ঠস্বর কেন জানি না অবিকল ফেলুদা-র মতো। আমরা জানি সমস্ত মারীকে পরাস্ত করে ‘পাঠশালা একদিন খুলবে’। আর যেদিন খুলবে— সেদিন-ই উৎসব। অমল ধবল পালে তখন তরণী বাওয়ার সুর— যে সুরের সঙ্গে কখন যেন মিশে যায় শৈশবের কাশের বনে ফেলে আসা দূরাগত রেলগাড়ির ঝংকার।
তখন, হ্যাঁ— ঠিক তখন-ই পুজো।