।। ১ ।।
আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে
যে কথা শুনায়েছি বারে বারে।।
আমার পরানে আজি যে বাণী উঠিছে বাজি
অবিরাম বর্ষণধারে।।
কারণ শুধায়ো না, অর্থ নাহি তার,
সুরের সঙ্কেত জাগে পুঞ্জিত বেদনার।
স্বপ্নে যে বাণী মনে মনে ধ্বনিয়া উঠে ক্ষণে ক্ষণে
কানে কানে গুঞ্জরিব তাই
বাদলের অন্ধকারে।।
সময়গুলো এখন আর ঠিকঠাক মেলে না মিহিরের। আজ প্রায় ছ-মাস বাড়িতে বসা। না, চাকরি যায়নি। অবসরও নেয়নি। গত ছ-মাস ওকে কলেজ যেতে হচ্ছে না। নাহ, এতটাও মহান সে নয় যে বাড়িতে বসে মাইনে নিতে তার বাঁধছে। আসলে এই হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া মহামারীর সময়টা যে জীবনে আসতে পারে, সেটা ভাবতে পারাও একটা অসম্ভব ব্যাপার।
একটা ঘটনা এখনও মনে পড়ে মিহিরের। তখন সবে উহান থেকে রোগটা সন্তর্পণে ছড়িয়ে পড়ার খবর আসছে। রোগ ছড়িয়ে যাচ্ছে ইউরোপ আমেরিকার কিছু জায়গা থেকেও। ফেসবুক স্ক্রল করলে মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ছে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এন.আর.আই-দের সাবধানবাণী। ঠিক ফেব্রুয়ারীর শুরুর দিকে বা মাঝামাঝি। দিন তারিখগুলো আজকাল ওঁর কেমন গুলিয়ে যায়। হ্যাঁ, ওইরকম সময় নাগাদ কলেজের কয়েকজন অধ্যাপক বন্ধু মিলে রওনা হয়েছিল সাংসির। উত্তরবঙ্গের একটি ভার্জিন পাহাড়ি গ্রাম।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ট্রেন পৌঁছল ভোর ছটায়। বাতানুকুল ওয়েটিংরুম সংলগ্ন টয়লেট ব্যবহার শেষ হলে ওরা গাড়ি খুঁজতে বেড়িয়েছিল। অরুণাভ তখন কয়েকজন চ্যাপটা নাকের পাহাড়ি ছেলে-মেয়ে দেখে কানে কানে মিহিরকে বলেছিল— ‘বুঝলি, সাবধানে থাকতে হবে। কোনটা এখানকার আর কোনটা চীনা বুঝছি না তো। তারপর আমাদের হয়ে গেলে?’
মিহির কথাটা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল— ‘ধুর, কী যে বলো না! এরা উত্তরবঙ্গের বা উত্তর-পূর্ব থেকে আসা লোকজন। জীবনে হয়তো একবারও চীনমুখো হয়নি।’ পাহাড়ে ওঠার আনন্দে ব্যাপারটা ওখানেই ধামাচাপা পড়ে যায়। পাহাড়, তিস্তা, মোমো, নেপালি গান— সবকিছু নিয়ে ঝড়ের বেগে কেটে গিয়েছিল ওদের চার-পাঁচদিন। সাংসির থেকে ফেরার দিন দশেকের মধ্যেই অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ হয়ে যায় স্কুল-কলেজ।
তারপর থেকে সময় কাটছে অনির্দিষ্ট ছন্দে। একটা সময় দূরে চাকরি হওয়ায় পরিবারের সংসর্গ পাওয়ার জন্যে মুখিয়ে থাকত মিহির। আজ তাদের সঙ্গেই কাটছে ঘণ্টা-দিন-মাস। মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের উন্নতি, স্ত্রী-র সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি কমে যাওয়া— এগুলোও যে এই ক-মাসে ঘটেছে, তা তো অস্বীকার করার জায়গাই নেই।
আচ্ছা চলুন আমরা একটু বুর্জোয়া হয়ে যাই। মিহিরকে এবার অধ্যাপক এবং সরকারের আলমারি থেকে মোটা মাস-মাইনে পাওয়া লোক হিসেবে দেখি। এই লকডাউনেও যাদের হেঁসেলে রোববারের খাসির অভাব হয়নি। সুতরাং মিহির, তুমি বা তুই থেকে সরাসরি আপনি হয়ে যাবেন এবার।
মিহির এখন রোজ যে জিনিসটার অভাববোধ করেন তা হল— ছাত্রছাত্রীদের মধ্যমণি হয়ে থাকা। ঘরে বসে মাইনে নিতে ওঁর আপত্তি নেই। কিন্তু প্রতি রাতে একটা ভয় ওকে বিদ্ধ করে। ছাত্রদের থেকে তিনি হারিয়ে যাচ্ছেন না তো? এই দ্বন্দ্বটি বোধহয় বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। বাবার ছিল কোচিং সেন্টার। বাবাকে তিনি ছোটোবেলা থেকেই দেখেছেন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যমণি হিসেবে। বাবার মতন কোচিং সেন্টার করার বা সেটা ধরে রাখার সাহস মিহিরের নেই। তাই বরাবরই এসবের থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন, সচেতনভাবেই। কিন্তু পেশা হিসেবে অধ্যাপনা বেছে নেবার পর দেখেছেন— এই পরিবৃত হয়ে থাকাটা একটা নেশার মতন। বাড়ি থেকে দূরে, কলেজের কাছাকাছি থেকেই অধ্যাপনা করেন তিনি। তাই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গা ভাসিয়ে দিতে কোনোদিন দ্বিধাবোধ করেননি। অথচ প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে পরিবারের অভাববোধ করেছেন। আসলে জীবন সবসময় বেছে নেওয়ার সামনেই দাঁড় করিয়ে দেয়। কলকাতা সংলগ্ন ফ্ল্যাট ছেড়ে তার স্ত্রী, মেয়েকে নিয়ে গ্রামে আসতে রাজি হননি। এতে সরমার কোনো দোষ দেখেন না মিহির।
সন্তান হওয়ার পর যে কোনও নারীই স্বামীর তুলনায় সন্তানকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। যুগে যুগে এই নিয়মই চলছে। বাবা হিসেবে মিহিরও চাননি শহরের সহজলভ্যতা থেকে স্ত্রী মেয়েকে গ্রামে এনে ফেলতে। মেয়ের পড়াশুনো, পরিবারের সকলের চিকিৎসা— সব কিছুই ভাবতে হয়। সুবিধে একটাই। সরমা মিহিরের অনুপস্থিতিতে সংসার চালিয়ে নেন শক্ত হাতে। ভালোবাসার সঙ্গে এই একটা কারণেই সরমার প্রতি শ্রদ্ধায় নত হন মিহির। তিনি জানেন, সংসারি কাজে তিনি নিজে কতখানি অপটু। এই অনির্দ্দিষ্টকালীন প্রায়-অবসরে সরমাকে কাছ থেকে দেখে সেই শ্রদ্ধা অনেকখানি বেড়ে গেছে মিহিরের। তিনি জানেন, পরিবারের এই সঙ্গ পাওয়াটা হঠাৎ করেই একদিন শেষ হয়ে যাবে। আপাতত যতটা রস শুষে নেওয়া যায়!
তবু আজকাল ছাত্রছাত্রীদের থেকে দূরত্বের ব্যাপারটা তাকে ভাবাচ্ছে। হাইস্পিড ইন্টারনেটের যুগে অনলাইনে ক্লাস যদিও চলছে, তাতে মানসিক দূরত্ব মেটে কি? দিনের পর দিন কলেজ ছেড়ে থাকাটাও আবার মিহিরের মনে ছাপ ফেলছে। তার মধ্যে একটা অদ্ভুত জিনিস ঘটছে। আগে তারিখের হিসেব গুলিয়েছে। এখন গোলাচ্ছে বারের হিসেবও। আগে রোজ রুটিন দেখতে হতো। কবে কাদের কী পড়াবেন, তার একটা হিসেব থাকত। অনলাইন ক্লাসে সেই ধরাবাঁধা সময়ের ব্যাপারটা নেই। নিতে হবে তাই নেওয়া। এভাবে যে কিছু শেখানো যায় না, তা মনে-প্রাণে মানেন মিহির। এখন মাঝে মাঝে বারগুলো গুলিয়ে গেলে ছাত্রছাত্রীরা মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় ক্লাসের কথা। আসলে বেড়ানো পাগল মিহিরের কাছে পাড়া সীমানার বন্দীজীবন এক গভীর অবসাদ বয়ে এনেছে। বইয়ের পাতায় ডুব দিয়েছেন তিনি। রান্না করেছেন প্রিয় খাবার। তবুও বুঝেছেন— এভাবে চালিয়ে যাওয়াটা বেশ কঠিন।
তাই আজকাল মিহির একটা অন্য কথা ভাবছেন। বন্ধু অরিন্দমের মতন একটা উপন্যাস লিখবেন তিনি। এই শখ মিহিরের দীর্ঘদিনের। কিন্তু মনঃসংযোগ হয়নি। বেশ ক-দিন ধরে ভেতর থেকে একটা কলম ধরার টান অনুভব করছেন। এই লকডাউনে কয়েকটা গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু একটা বড়ো গল্প যেন দানা বাঁধছে তার বুকের ভেতর। কেউ পড়ুক না পড়ুক, নিজের এই গল্পটাকে একটা অবয়ব দিতে চাইছেন মিহির। কারণ ক-দিন ধরেই গল্পের চরিত্রগুলোকে তিনি অনুভব করছেন নিজের চারপাশে। নিজের জেগে থাকা বা ঘুমানোর সময়। সময়ের স্তরগুলো পালটাচ্ছে চোখের সামনে। এগুলোকে কলমে না ধরলে ঘুড়ির মতন উড়ে যাবে। একবার ভো-কাট্টা হলে উপায় নেই।
অনেককাল আগে কলেজে পড়ার সময় তার এক অধ্যাপিকা বলেছিলেন— তার কলমে নাকি যাদু আছে, খাতার পাতায় ছবি আঁকতে পারে। ঘোলাটে এই সময়ের ভিতর মিহির নিজেকে দেখেন এক জাদুকরের বেশে। হাতে জাদুদন্ডের বদলে একটা কলম। তার মাথায় একটা বড়ো সাহেবি হ্যাট, যার থেকে প্রতি মুহূর্তে বের হচ্ছে ছবির পর ছবি। আর সুচারুভাবে মিহির কলমের নিবে বিদ্ধ করছেন একটির পর একটি এবং আটকে দিচ্ছেন দেওয়ালে। দর্শকাসন শূন্য।
top of page
SKU: SRJN-1
₹200.00 Regular Price
₹160.00Sale Price
No Reviews YetShare your thoughts.
Be the first to leave a review.