অ্যান্ড্রোমিডা
ঋতম চক্রবর্তী
১.
মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর যে আলোকিত অংশটা দেখা যাচ্ছে এখন, ওইখানে আমার শহর, ওখানেই তোমরা সবাই আছ। এখন একটা স্পেসস্টেশনে থেমে আছি। আগামীকাল যখন একটা ভেলোসিটি থ্রাস্টার আরও গভীর মহাশূন্যের দিকে ঠেলে দেবে আমাদের মহাকাশযানটাকে, তখন তোমাদের ওখানে রাতে সবাই হয়তো ঘুমিয়ে থাকবে বিছানায়। তাই আগাম শুভরাত্রি।
২.
চাঁদের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছি। পৃথিবী থেকে চাঁদকে যতটা সুন্দর দেখায়, চাঁদ থেকে পৃথিবীকেও ঠিক ততটাই। তোমরা কেমন আছ?
৩.
পুচুর শরীর খারাপের খবরটা পেয়েছি গত-পরশু। তারপর কমিউনিকেশন ছিল না তাই আর কিছু জানি না। খুব চিন্তা হচ্ছে। জানিও।
৪.
এইমাত্র মঙ্গলের কক্ষপথ পেরোলাম, যদিও স্বচক্ষে গ্রহটাকে দেখতে পাইনি। বাবার সুগারটা বেড়েছে জেনে চিন্তা হচ্ছে। মেপে খেতে দিও। মা আর পুচু কেমন আছে জানিও।
৫.
বিল্টুর মেয়ে হয়েছে শুনে খুব খুশি হলাম। ওরা সুখে থাকুক। বাকিদের খবর জানিও। আমরা বৃহস্পতির দিকে।
৬.
কী বলব বুঝতে পারছি না! চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে বাবার মুখখানা। বাবা বাজারের থলি নিয়ে ফিরছে। মাঝে মাঝে বাবার ঘরে ঢুকে দেখতাম টিভিটা চলছে, বাবা কখন জানি না ঘুমিয়ে পড়েছে। সাবধানে চশমাটা খুলে রেখে দিতাম। বড্ড দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখানে অক্সিজেন আছে, কিন্তু হাওয়া নেই কোথাও এতটুকুও।
৭.
গত কয়েকমাস ধরে বৃহস্পতি দেখলাম দূর থেকে। একটু একটু করে কাছে এলো আবার একটু একটু করে দুরেও সরে গেল তেমনি। চারিদিক অন্ধকার, থমথমে, জনপ্রাণীহীন। বড্ড মনে পড়ছে ওখানকার দিনগুলো। ততই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে মন। যাই হোক, ভালো থেকো।
৮.
সবকিছু বেশ ভালো করে মিটেছে জেনে খুশি হলাম। পুচুকে জানিও, ওদের আশীর্বাদ করলাম দূর থেকে। ওরা সুখী হোক। আমরা শনির পথে। এরপর কিছুদিন যোগাযোগ থাকবে না, জায়গাটা ব্ল্যাক জোন। তোমার শরীরের যত্ন নিও। মায়ের যত্ন নিও।
৯.
মায়ের খবরটা পেলাম। বয়স হয়েছিল, কষ্ট পাচ্ছিল। পুচুকে বুঝিও, সবাইকে একদিন চলে যেতে হয় এভাবেই। যতদিন বাঁচা, তার মধ্যেই সবকিছু। মায়ের শাড়িতে যে মনখারাপের গন্ধ থাকে, সেটা আজও পাচ্ছি, এতকাল পরে এতদূর থেকেও। মায়া বড়ো জ্বালাতুনে, কিছুতেই পেছন ছাড়ে না। যাইহোক, তোমরা ভালো থেকো। আমরা আপাতত ইউরেনাসের দিকে।
১০.
পুচুদের ডিভোর্সের খবরটা পেলাম। মনটা ভালো নেই। প্রিয় মানুষের কাছে থাকা যে কতটা শান্তির, সেটা হয়তো দূরে গেলেই বোঝা যায়। একই শহরে, একই বিছানায় থেকেও মানুষের মধ্যে কত ব্যবধান, তাই না? অথচ দ্যাখো, আমাদের মহাকাশযান আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে একটু একটু করে, তবুও আমরা... ওকে বুঝিও, সম্পর্কের টান অভিকর্ষের থেকেও জোরালো।
১১.
পরিচিত অথবা পরিচয়হীন যা কিছু তোমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে প্রতিনিয়ত, আমি তার কিনারায় এসে ঠেকেছি। আর একটু এগোলেই সম্পূর্ণ অন্য এক জগৎ, যেখানে তোমাদের কোনো নিয়মই আর খাটবে না সেভাবে।
এতখানি পথ, এতগুলো বছর পেরিয়ে আসতে আসতে একটা কথাই ভেবেছি বারবার, এই ব্রহ্মাণ্ডে মানুষই হয়তো সব থেকে একলা এবং নির্জনতম প্রাণী। হয়তো বিজ্ঞানীরা একদিন বুঝতে পারবে, যে পৃথিবীর মতো আর একটাও গ্রহ নেই কোথাও। হয়তো একদিন প্রমাণিত হবে, ওই ফ্যাকাসে নীলচে রঙের গোলাকৃতি বস্তুটাই আমাদের একমাত্র উপযোগী বাসস্থান। সেইদিন সব খোঁজা শেষ হবে। সেইদিন সবাই সব কিছু ছেড়ে আবার ঘরে ফিরে আসবে শেষবারের মতো।
এই কথাগুলো প্রতিধ্বনি হয়ে তোমার কাছে পৌঁছবে যখন, ততদিনে আমাদের মহাকাশযানটা এই অন্ধকারে এগিয়ে যাবে আরও অনেকটা পথ। আসতে আসতে মিলিয়ে আসবে সবকিছু। তবুও আমার স্থির বিশ্বাস, হয়তো কোথাও আবার একদিন দেখা হয়ে যাবে আমাদের। ততদিন, ভালো থেকো।
আয়নাতন্ত্র । ঋতম চক্রবর্তী
Within Chandannagar : 20 rs
Out of Chandannagar : 65 rs
Out of West Bengal : 85 rs