সেই কতকাল আগে তাবড় এক মহারাজের আদুরে মেয়ে নিজের কুলমান সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিরুপদ্রব ভবিষ্যৎ ভাসিয়ে প্রেমে পড়ে গেল চালচুলোহীন কবি হৃদয়ের এক উদাসী পাগলের। তার নেশাঘোর চোখ, ছাই-ছাই মন। বিজন মাঠের জ্যোৎস্না কিরণের ন্যায় শান্ত বিভাস। নিজের মধ্যে বুঁদ হয়ে কী যে অন্বেষণ করে চলেছে সে খ্যাপা কেউ তার হদিশ পায় না। সেই আদিম রহস্যগন্ধেই মোহগ্রস্তের মতন অভিজাত মেয়েটি নিজের এতদিনের লালিত যা কিছু সমস্ত জলাঞ্জলি দিয়ে বিবাগী মানুষটাকে একদিন বিয়ে করে বসল কিনা কে জানে! কোন সাহসে সমাজের তোয়াক্কা না করে এক-কাপড়ে গিয়ে দাঁড়াতে পারল গাছের তলায়! ঘর বেঁধে থেকে যেতে পারল শ্মশানে-মশানে!
তারপর যুগ যুগ ধরে তাদের দাম্পত্য জীবনকে ঘিরে কত গল্পগাথা, কত রকম পুরাণ রচিত হল। কত কবি কত কবিতা বাঁধলেন, কত তাপস কত অর্চনার অর্ঘ্য সাজিয়ে দৈবী উচ্চতায় বসিয়ে দিলেন সেই প্রেমিক যুগলকে।
আজ অংশুমান আমায় একটা ছবি দেখাল। ওদের ফারাক্কায় গঙ্গাপাড়ের কোনো এক গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছেন সেই মহাভিক্ষু আর তার ঘরণি। তাদের ঘিরে শীতের রোদ, উত্তুরে হাওয়া, দারিদ্র্যের ছাপ। তবু কোথাও কোনো মালিন্য নেই, নেই কোনো অভিযোগের গ্লানি।
ভালোবাসা শব্দটায় বুঝি এক রকম আশ্রয় আছে। তার মধ্যে ডানা মুড়ে বসা যায়। খুদকুঁড়ো কুড়িয়ে এনেও তাই পরস্পরে ভাগ করে নেয় মানুষ। দুঃখ দিনের পাশে নিরলস জেগে থাকতে পারে, ঠায়। কেবলমাত্র ‘আছি’ এই শব্দটুকুর ভরসায় তুচ্ছ করে দিতে পারে সমস্ত রুক্ষদিনের দাহ।
এই সেই সনাতন পুরুষ ও তার প্রিয়া, যাদের অন্তরমহলকে বিরহ ব্যতিত অন্য কোন দুঃখ স্পর্শ করল না কোনদিন অথচ তাদের আপাত দুঃখযাপনের কষ্টকে কল্পনা করে এই বাংলার কত কত কবি মা মেনকার বকলমে অনন্ত মমতায় তাদের জন্য অশ্রুমোচন করে গেলেন নিজেদের গানে, আজন্মকাল।
আমার মনে পড়ছিল গিরিশচন্দ্রের কথা। সাহানা রাগের একটা গান। বাপের বাড়ির বৈভবে এসে মধ্যরাত পার করা নিস্তব্ধতায় সেই সুদূর বৈরাগীর জন্য মন কেমন করছে মেয়েটির। তার মনেও ঘন হচ্ছে বৈরাগ্য-ফাগ। সেই আবিরে একটু একটু করে আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ফেলে আসা প্রেম। কোন এক মহাকায় শূন্যতার ভেতর তার পক্ষীমাতার মতন এতটুকু মায়াহৃদয় ভেঙেচুড়ে তলিয়ে যেতে যেতে আঁকড়ে ধরতে চাইছে নিঃসঙ্গ প্রেমিকের স্মৃতি। পরস্পরে লগ্ন হয়ে থাকার যাবতীয় মুহুর্ত। নিত্যদিনের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়ে যাবার আদর, আরাম, নিরাপত্তা।
জন্ম জন্ম ধরে এই মায়াতেই বোধহয় পৃথিবীর সব বিচ্ছেদ-দূরত্ব অতিক্রম করে চলে মানুষ। সমস্ত অভাবকে নস্যাৎ করে সে নিজের মধ্যে অনন্ত খুঁজে পায়।
তাকে প্রেম বলে চিনি। তাকে ঈশ্বর নাম দেওয়া যায়।
ছবি : অংশুমান ঠাকুর
Comments