top of page

মুক্তি । দেবলীনা চক্রবর্তী

বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। দ্রব হয়ে থাকা ফুসফুসটা শেষবারের মতো ছিনিয়ে নেওয়ার

চেষ্টা করছে প্রাণবায়ুর অদৃশ্য কণাগুলোকে। শ্বাসনালীর কোশগুলো তীব্র জ্বলনে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।

আরো একবার চোখটা খোলার চেষ্টা করল মহাবীর। চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে আরও একবার ধরিত্রী মায়ের রূপ দেখার ইচ্ছে জাগছে যে!

কিন্তু এই তিন গজ চওড়া কুঠুরির লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে বিশ্বপ্রকৃতির কতটুকুই বা ধরা দেয়। আর যেটুকু দেখা যায়, তার সত্তর ভাগই দখল করে আছে অদূরের কুঠুরিগুলোর পেছনের সাদা দেওয়াল।

তবু ওই বটগাছটা রয়েছে নির্বাক স্বাক্ষী আর নিঃস্বার্থ বন্ধু হয়ে। গ্রীষ্মের উষ্ণ বাতাসে ওঁর পাতায় ঝিরিঝিরি নাচন লেগেছে। মৃদু লয়ে দুলছে ওর শাখা-প্রশাখাগুলো। যেন তাকে শেষ বিদায়ের সম্বর্ধনা জানাচ্ছে।

মহাবীরের চোখের সামনে দুলতে থাকা ধূসর দৃশ্যটা একটু একটু করে যেন বদলে যাচ্ছে। হাজার হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে, সময়ের চাকাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে প্রায় বিশ বছর আগের সময়ে। ওই তো উত্তর প্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম সাহাপুর। তীব্র গরমের দাবদাহে ফেটে গেছে মাটি। রুষ্ট প্রকৃতির রোষানলের হল্কা থেকে মাটির বাড়িটাকে রক্ষা করছে ওইরকমই একটা বটগাছ। যার তলায় একটা দড়ির খাটিয়া বাঁধা। ছোটো ছোটো ভাই বোন আর ক্ষুদে ইয়ার দোস্তদের সাথে সেখানে বসে আছে বছর নয়-দশের মহাবীর। বটবৃক্ষের শীতল ছায়ায় বসে স্বাদ নিচ্ছে মায়ের হাতে বানানো রোটি আর কাচ্চে ক্যারিকা আঁচারের (কাঁচা আমের আঁচার)। মাঝে মাঝে কাঁচা পেঁয়াজ, লংকায় কামড় আর লোটার শীতল জলে চুমুক। আহা! স্বর্গ!


মহাবীরের পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। শেষ কবে সে খাবার খেয়েছিল যেন? দিন সাত-আটেক হবে বোধহয়। খাঁচার ভেতর থাকতে থাকতে পাখি যেমন দিক ভুলে যায়, ওরাও তেমন গরাদের ভেতর থাকতে থাকতে কালের হিসেব করতে ভুলে গেছে। দিন... মাস... বছর কিছুই আর ঠিক মতো গুনে উঠতে পারে না।


এই খাওয়ার হিসেবটা বড্ড গোলমেলে। নিজের মনেই হেসে উঠল মহাবীর। প্রতিপদের চাঁদের মত ম্লান সেই হাসি। প্রকৃত অর্থে খাবার সে শেষবারের মত খেয়েছে বছর পাঁচেক আগে। এখানে যেটা দেওয়া হয়, সেটাকে খাবার বললে খাদ্যের অপমান হবে! পাথর আর কাঁকড়ে ভরা ভাত, পোকায় নষ্ট করে দেওয়া ডাল, শ্যাওলা ধরা থকথকে সবজি- এগুলোকে কি আদৌ খাবার বলা চলে?

সেদিক থেকে দেখতে গেলে গত কয়েকদিন কিন্তু সে বেশ পুষ্টিকর খাবার খেয়েছে। দুধ, চিনি, ডিমের মিশ্রণ- গুনগত মানের মূল্যায়নে অবশ্যই উৎকৃষ্ট। তবে হ্যাঁ, মুখগহ্বরের পরিবর্তে নাসিকাগহ্বর দিয়ে দেহে প্রবেশ করানো হলে সেটা আর খাদ্যের পর্যায়ভুক্ত থাকবে কিনা বলা খুব শক্ত।

কেশে উঠল মহাবীর। কাশির দমকের সাথে খানিকটা রক্তও বেরিয়ে এল। সত্যি ওই সাহেবটা ডাক্তার! একটা রবারের নলও ঠিক পথে ঢোকাতে পারল না? এরা নাকি আবার দেশ চালাবে!

অবশ্য ওকে খুব একটা দোষ দিয়ে লাভ নেই। প্রবল প্রতিরোধে মুচড়ে উঠছিল মহাবীরের শরীরটা। কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছিল সে। দু-দুজন রক্ষী তার হাত পা চেপে ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিল। ওই ডাক্তার আর জেলার সাহেব জোর করে ওর নাকের ভেতর দিয়ে টিউবটা ঢোকানোর চেষ্টা করছিল। নলটাই বোধহয় পথ ভুল করে পাকস্থলীর বদলে ফুসফুসে পৌঁছল।

হয়তো ভুল করে নয়, ইচ্ছে করে। যেমন করে মহাবীর জীবনের সোজা সরল পথটা ছেড়ে বেছে নিয়েছে এই বাঁকা পথ- যে পথের নীচে বিছানো রয়েছে কাঁটার গালিচা আর বাঁকে বাঁকে অপেক্ষা করে রয়েছে মৃত্যুদূত।

কিন্তু সেই পথের শেষে? কী এমন আছে সেই পথের শেষে, যার জন্য মায়ের আঁচলের ছায়া ত্যাগ করে, সংসার জীবনের মোহমায়া কাটিয়ে মহাবীরের মতো শত সহস্র যুবকেরা এগিয়ে চলেছে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে?

উত্তর একটাই। স্বাধীনতা... আজাদী। দেশমাতৃকার মুক্তি। পরাধীনতার শৃঙ্খলাভঙ্গের সম্মোহনী আকর্ষণই তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

মহাবীরের ঘোলাটে হয়ে আসা চোখদুটোর সামনে ঝলসে উঠল সেই দিনটার কথা। যেদিন প্রথম সে দেখেছিল, কতগুলো লালমুখো সাহেব একজন নিরীহ মানুষকে প্রকাশ্য রাস্তায় লাথি মারছে! গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছিল লোকটার নাক মুখ দিয়ে। বুটের আঘাতে থেঁতলে যাচ্ছিল তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। অপরাধ? সে ভারতীয়! কালো চামড়ার হিন্দুস্থানী। যার থেকে সাহেবদের পোষা কুকুরের জীবনের দামটা অনেকটাই বেশি।

সেদিন প্রথমবার সে অনুভব করেছিল তার রক্ত ফুটেছে। যেন রক্ত নয়, লাভা। শিরায় উপশিরায় ওই ‘ফিরঙ্গি’দের জন্য ‘নফরত’ আর ‘রাগ’ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। ইচ্ছে করছে ওই নিরীহ লোকটার জায়গায় ওদের ওইভাবে ফেলে মারতে, যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ।

সেই অবদমিত অভিপ্রায়ই প্রাণ পেল কানপুরে। কলেজে পড়ার সময়। স্বপ্নপূরণের অঙ্গীকার নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল নওজওয়ান ভারত সভা। সমভাবনার, সমমানসিকতার মানুষদের সাথে যুক্ত হতে পেরে মহাবীর যেন তখন হাতে চাঁদ পেয়েছে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে সামিল হতে পেরে মনে হচ্ছে- নিজের জন্ম স্বার্থক। ছোটবেলা থেকেই সে মায়ের মুখে শুনেছে, প্রচলিত প্রবাদ।

‘লাথো কে ভূত বাতো মে নেহি মানতে!’

আজ সুযোগ এসেছে সেই ভূতদের পায়ের তলায় নিয়ে আসার। দেশ মাতৃকার পবিত্র শরীরের ওপর যাঁরা লাঞ্ছনা করেছে, তাদের ধ্বংসের কান্ডারী হবে তারাই! ধীরে ধীরে কলেজ, পড়াশোনা, পরিবার, স্বাভাবিক জীবন সবকিছুকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে সে। দেশমাতা ছাড়া আর কোনো বন্ধন নেই তার। সামনে রয়েছে ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্তের মতো কমরেড। যাঁদের অভয় চিত্ত তার মনপ্রাণকে অনুপ্রাণিত করে বারবার।

আর তাই তো ওদের বিপদে পাশে থাকাটাই তার স্বধর্ম বলে মনে হয়েছিল। কুচক্রি সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যে ইতিহাসের পাতায় দ্বিতীয় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা নামে স্থান পাবে, তখন তা কী আর জানা ছিল মহাবীরের! নাকি এটা জানা ছিল যে, এত কষ্ট করে ভগৎজী, বটুকদা, আর দূর্গাদিদিকে পালাতে সাহায্য করাটা বিফল হবে? ওদের সকলের জন্যই যে জেলের কালো কুঠুরি অপেক্ষা করে রয়েছে- সেটাই বা কে জানত!

পাশ ফিরবার চেষ্টা করল মহাবীর। পারল না। বুকে অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে। চোখের কোণ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। না! শরীরের কষ্ট নয়, এ কষ্ট মনের।

জলের এত সুন্দর রং সে আগে কখনো দেখেনি। নীলচে সবুজ। যেন আকাশগঙ্গা মাটিতে নেমে এসেছে। কিন্তু মহাবীর জানত এই জলের ওপরেই রয়েছে নরক। এই জলের ছোঁয়ায় আছে কালনাগিনীর বিষ। যার কালো ছোবলে শেষ হয়ে যাবে তাদের আগত জীবন। তাই তো এটা কালাপানি!

নিজের দেশ, মাটি, জাত- সব নষ্ট করে যেদিন এই দ্বীপে সে প্রথম পা রেখেছিল, সেদিন তার চোখে বিষাদ ছিল না। ছিল পিপাসা। নিজের মাতৃভূমিকে আবার স্পর্শ করার পিপাসা। আর সেটা করতে হলে করতে হবে অপেক্ষা, রাখতে হবে ধৈর্য্য। দেশের মাটিতে হলে সে জানত, ঠিক বেরিয়ে আসবে। শয়তানগুলোর চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে আসবে। কিন্তু এটা যে সাক্ষাৎ নরক গুলজার। সাতটা সাপের ফনার মতো নিষ্ঠুর গারদমহলের চারিদিকে পাহারা দিচ্ছে ওই বিষেভরা কালাপানি। পালানোর পথ নেই।

এই জাহান্নামের যমরাজ ডেভিড বেরি, পোর্ট ব্লেয়ারের স্বঘোষিত ঈশ্বর। কালোচামড়ার বিপ্লবী বন্দীদের রক্ত দেখলে যার অন্তরাত্মা পৈশাচিক উল্লাসে মেতে ওঠে। তৃপ্ত হয় ওদের দলিতমথিত আহত শরীরের ক্ষত দেখে। আর তাই তারই নির্দেশে মহাবীরের মতো কত শত বীরদের জীবন হয়ে উঠেছে মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর।

তৃষ্ণার্ত অনুভব করল মহাবীর। ফুসফুস তরলে ডুবে গেলেও গলাটা যে শুকিয়ে আসছে। মৃত্যুর আগে দুফোঁটা জলও কী তার নসীবে নেই! এত পাপ করেছিল সে!

যে দ্বীপের চারিদিকে অকূলপাথার, সে দ্বীপেই অধিষ্ঠিত এই কারাগারে জলের অভাব যে চিরকালীন। ছয় ঘন্টা ধরে একটানা নারকেল থেকে ছোবড়া বের করতে করতে সুশীলের হাত দুটো সেদিন রক্তে ভরে উঠেছিল। গলা শুকিয়ে কাঠ। একটু জলের আর্জি জানিয়ে ছিল সে। জলের বদলে চাবুকের একশোটা আঘাতে পিঠের চামড়া ফালাফালা হয়ে গেছিল তার।

মহাবীরের বুক ঠেলে দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। সুশীলের সাথে তার এখানেই পরিচয়। মাত্র কয়েক বছরেই ছেলেটা তার বড়ো আপন হয়ে গেছে। তাকে শেষবারের মতো একবার দেখতেও হয়তো পাবে না! তাও তার নিজের, সুশীলের, সাভারকারজীর সহ্য ক্ষমতা অসীম বলতে হবে। না হলে উল্লাসের মতো তাদেরও এতদিনে উন্মাদ হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কলুর বলদের মতো ঘানিতে নারকেল পিষে তেল বের করত উল্লাস। সেবার সে পর্যাপ্ত পরিমাণ তেল তৈরি করতে পারেনি। তাই তাকে শাস্তি পেতে হল। তিনদিন ওকে ওই মাঠের মাঝে হাত বেঁধে রেখে দেওয়া হল। সঙ্গে অগুনতি চাবুকের ছোবল। তিনদিন পর মুক্তি পাওয়ার সময় তার কালশিটে পড়া চামড়া ফেটে রক্ত ঝরছিল। কিন্তু ব্যথা অনুভব করেনি। তার মস্তিস্ক ততক্ষণে ব্যথা-যন্ত্রণা-শোক-তাপ অনুভবের উর্দ্ধে চলে গেছে। জগতের চোখে সে উন্মাদ!

পশুদের চেয়েও হীন জীবনযাপন করে এসেছে তারা। নিজেরই ত্যাগ করা মলমূত্রের পাশে দিনের পর দিন পড়ে থেকেছে; এক টুকরো সাবান জোটেনি কাপড় কাচার জন্য, স্নানের জন্য; অকথ্য গালিগালাজ, অত্যাচার সয়েছে। শারীরিক, মানসিক সবদিক থেকে বিধ্বস্ত হয়ে তিলে তিলে শেষ হয়ে গেছে।

ইন্দুভূষণদাদা নিজেকে শেষ করে দিল। আরো কতজন নিজেকে শেষ করার চেষ্টা করল। কেউ কেউ চিরমুক্তি পেল, কেউ পেল না! স্বর্গের দুয়ারও বুঝি তাদের জন্য বন্ধ! আর তাই তো ওরা চেষ্টা করেছিল। আরো একবার গর্জে ওঠার, প্রতিবাদ করার। শুরু করল আমরণ অনশন। না মুক্তি মিলবে না, সে তারা ভালো করেই জানে। কিন্তু একটা মানুষের মতো জীবন তো তারা পেতেই পারে! একটু ভালো খাবার, যেটাকে অন্তত খাবার বলা যায়। একটু পরিচ্ছন্নতা, একটা খবরের কাগজ, অমানবিক শ্রমের একটু হ্রাস, ব্যস! এতটুকুই চাহিদা ছিল ওদের। কিন্তু ওই মানুষের মুখোশধারী পিশাচগুলো এটুকুও দিতে চায়না। ওদেরকে পিষে ফেলতে না পারলে শান্তি নেই।

এবার জলের কলসিতে দুধ মিশিয়ে দেওয়া শুরু করল ধূর্ত শয়তানগুলো। কিন্তু ওরা জানেনা, কাদের সাথে লড়তে এসেছে। ভারত মায়ের বীরক্রান্তিকারীরা এত সহজে হেরে যাবে? বহুদিন পর ফুটবল খেলার সুযোগ পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠল তারা। কলসিতে লাথি মেরে দুধের গঙ্গা বইয়ে দিল।

নিজেদের হার আসন্ন বুঝেই শয়তানগুলো বুঝি আরো দানবিক হয়ে উঠল। পৈশাচিক পন্থা অবলম্বন করল ওদের অনশন ভাঙানোর জন্য। নাক দিয়ে রবারের নল পাকস্থলীতে ঢুকিয়ে ঢেলে দেবে তরল খাদ্য। সেই দুষ্পরিনামে আজ মহাবীর মৃত্যুর প্রহর গুনছে। নলের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে তার শ্বাসনালী। ফুসফুসে নলের তরল ঢুকে তীব্র নিমোনিয়ার সৃষ্টি করেছে। মহাবীরের সঙ্গে তার বন্ধু মোহনকিশোর আর মোহিত দুজনেরই একই পরিণাম ঘটেছে।

আর শ্বাস নিতে পারছে না মহাবীর। জল থেকে তুলে আনা মাছের মতো ছটফট করছে, খাবি খাচ্ছে জীবনের ন্যূনতম চাহিদাটুকু পূরণের জন্য। শরীর অসাড় হয়ে আসছে।

‘আ যা মেরি বুলবুল.... তুঝে দেশ কি গীত শুনাও...’- অচেনা গানের সুর ভেসে আসছে দূর থেকে। সাভারকার তার কুঠুরির বাইরে চড়তে থাকা পাখিগুলোকে গান শোনাচ্ছে বোধহয়। সুরের জাদুতে শান্ত হয়ে আসছে মহাবীরের মনপ্রাণ। অবসন্ন মস্তিস্কভ্রমের সৃষ্টি করছে। সাভারকার নয়, এ গান যেন তার মা গাইছে। ঠিক যেমনভাবে ছোটোবেলায় তাকে ‘লোহরি’ শুনিয়ে ঘুম পাড়াত।

বুজে আসা চোখ দুটো দিয়ে একটা আবছা দৃশ্য দেখতে পেল মহাবীর। খুব ঘোলাটে আর অস্পষ্ট। গানের কলি গুনগুন করতে করতে তার মা এগিয়ে আসছে তার দিকে। পরনে সাদা শাড়ি। একটু এগিয়েই থমকে দাঁড়াল মা। ও কী! দুহাতে আর পায়ে যে লোহার বেড়ি পড়ানো। অনেক চেষ্টা করছে ওগুলো ছাড়িয়ে এগিয়ে আসতে, কিন্তু পারছে না।

মহাবীর ক্রমশ অবশ হয়ে আসা হাতটা ওঠানোর চেষ্টা করল....পারল না। কিন্তু চোখের সামনে ও কী দেখছে!

কোথা থেকে একটা দশ-বারো বছরের ছেলে ছুটে এল তার মায়ের দিকে। পাথরের আঘাতে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে লোহার বেড়ি, শেকল। মুক্ত হয়েই মা জড়িয়ে ধরল ছেলেটিকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পরম স্নেহে।

শেষবারের মতো চোখদুটো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে ছেলেটির মুখটা দেখার চেষ্টা করল মহাবীর। এ যে তারই মুখাবয়ব, কিশোর বয়সের। মৃদু হাসছে তার দিকে চেয়ে।

মহাবীর হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই তার চোখ দুটো বন্ধ হল।


বলা হয় ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। মৃত্যুর আগে দেখা স্বপ্ন? তা কি সত্যি হতে পারে না!


****************


মহাবীর সিং ছিলেন ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবী। তাঁর জন্ম ১৬ই সেপ্টেম্বর ১৯০৪ সালে উত্তর প্রদেশের ইটাহ জেলায়। কানপুরে ডিএভি কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি নওজওয়ান ভারতসভায় যোগদানের সাথে সাথে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অংশীদার হন। লাহোর দ্বিতীয় ষড়যন্ত্র কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত এবং দুর্গাবতী দেবীকে পালাতে সাহায্য করার দায়ে তিনি দণ্ডিত হন এবং আন্দামানের সেলুলার জেলে তাঁকে নির্বাসিত করা হয়। বন্দীদের প্রতি অমানবিক অত্যাচারের প্রতিবাদে সেখানে ১৯৩৩ সালে অনশন সংগ্রাম শুরু হয়। তিনি তাতে সক্রিয়রূপে অংশগ্রহণ করেন। অনশনরত অবস্থায় তাকে বলপূর্বক খাবার খাওয়ানোর অপচেষ্টার পরিণাম স্বরূপ ১৭ই মে ১৯৩৩-এ তিনি মারা যান। এই আন্দোলনে মোহিতমোহন মৈত্র এবং মোহনকিশোর নমোদাসও শহীদ হয়েছিলেন। সেলুলার জেলের প্রাঙ্গনে তাঁদের মূর্তি নির্মিত রয়েছে।


এই গল্পে কাল্পনিক দৃশ্যায়নের মাধ্যমে তৎকালীন সময়ে সেলুলার জেলের ভেতর ঘটে চলা নারকীয় এবং অমানবিক অত্যাচারের কথা তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের দেশনায়করা ঠিক কতটা যন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন আমাদের মুক্ত করতে, স্বাধীন জীবন দিতে, তার আবছা অবয়ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। ‘কালাপানি’ নামে কুখ্যাত সেই দণ্ড বাস্তবিকভাবে কতটা কঠিন ও কালো ছিল তার আভাসটুকু দেওয়া হয়েছে মাত্র। আমাদের দেশের সেই বীরসন্তানরা, যাঁদের পবিত্র রক্তে স্নাত হয়ে আমাদের দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হতে পেরেছে, এই গল্পের মাধ্যমে তাঁদেরকে আন্তরিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হল।

 
 
 

Comments

Couldn’t Load Comments
It looks like there was a technical problem. Try reconnecting or refreshing the page.
1111-removebg-preview.png

গল্পের বই উপহার পেতে কে না চায়!
এখনই Subscribe  করুন,
আর পেয়ে যান আপনার প্রথম বইটির মূদ্রিত মূল্যের ওপর ২৫% ছাড় 

Thanks for being our family!

  • Youtube
  • pngwing.com
  • 1111
  • tumblr
  • Instagram LOGO PNG2

+91 8240333741

Magic Seeds Books LLP

119 Abhay Patuli Lane, Shuksanatantala, Chandannagar 712136

Email us at: manikarnika.pub@gmail.com

For any other queries feel free to reach us at: 8240333741(Call/Whatsapp)

©2022 by Manikarnika Prakashani.

bottom of page