ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত এক জীবন্ত রেখা। যেন তার প্রাণ আছে। কত কাহিনি, কত চলাচল
তাকে ঘিরে, তাকে মাড়িয়ে মাড়িয়ে। এই নিয়ে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়েছে অনেক বই। যেমন ফিকশন, তেমনই ননফিকশন। সম্প্রতি পড়লাম রাজা সরকার-এর লেখা ‘নৃমুণ্ডের মীমাংসা’। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা হলেও বিশালায়তন এই উপন্যাস বারে বারেই ছুঁয়ে এসেছে পার্টিশনের কাল। বাংলাদেশ নিবাসী এক হিন্দু পরিবারের কর্তা ধলা মজুমদার। সে চিন্তাশীল মানুষ। সে প্রায় নিয়ম করে ডায়েরি লেখে। সেই লেখায় ধরা পড়ে তার গভীর মন। ‘নৃমুণ্ডের মীমাংসা’কে যেন বলা চলে দুটি বই, একটি উপন্যাস, আর অন্যটি মূল উপন্যাসের মধ্যেকার ধলা মজুমদারের ডায়েরি। কত মৌলিক ও জরুরি চিন্তার ছাপ পড়েছে সেইখানে, তাই তাকে স্বতন্ত্র বই বললে অত্যুক্তি হয় না।
উপন্যাসের মধ্যে সেভাবে কোনো ক্লাইম্যাক্স নেই। অথচ রয়েছে এক সাবলীল সচলতা। এর ভাষা, কথনভঙ্গীমা, চরিত্রের রূপায়ণ ধ্রুপদী ধরনের। অনেকদিন পর এমন বই পড়লাম। দেখা যায় একটি বিশেষ কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু লেখা হলে, লেখার সমস্ত মন পড়ে থাকে ওই ঘটনার দিকেই। যেন তাকে ছাড়া আর কিছু ঘটছে না জীবনে। কিন্তু ‘নৃমুণ্ডের মীমাংসা’ এমন নয়। দেশের আলোড়নের এক কাল নিয়ে লেখা হলেও সেখানে রয়েছে নিয়ত জীবনের ছবি, ধলা মজুমদার-সুমতি-বাসন্তী-অতসী-পেয়ারীদের চোখে দেখা যায় মাঝে মাঝে: ওই ধলা বন্ধুদের দিয়ে আলোচনায় বসেছে, বাসন্তী চলেছে স্কুলের পথে, সুমতি চেয়ে আছেন উঠোন পার করে দেশত্যাগী আত্মীয়দের বাড়ির দিকে। নৃমুণ্ডের মীমাংসার মধ্য দিয়ে তৎকালীন বাংলাদেশে অবস্থিত একটি সাধারণ হিন্দু পরিবারের মনস্তত্বটিকে দেখা যায়। অনেকটা যেন অতিকথন আর সাজসজ্জার খোলস ছাড়িয়ে। এই ছবিই বোধহয় সত্যিকারের চিত্রণ। এই বইটি অনেকের পড়া দরকার। এইভাবে সৎ-সাহিত্যকে লালন করা হয়।
সর্বোপরি বইটির গঠনের কথা না বললেই নয়। এত সুন্দর করে বইটি করা হয়েছে – যেমন তার অঙ্গসজ্জা, তেমন ছাপা, পাতা, বাঁধাই, প্রচ্ছদ, অলঙ্করণ। কোথাও কোনো অতিরিক্ত কিছু নেই। পাতার মার্জিনও যেন খুব ভেবেচিন্তে রাখা। পড়তে খুব ভালো লাগে। প্রকাশনীর কর্মীরা অত্যন্ত সহৃদয়ভাবে আমার পছন্দ জেনে নিয়ে এই বইটি পড়বার পরামর্শ দেন। বলতে দ্বিধা নেই, একটু মোটাসোটা দামী বই কেনবার আগে দ্বিধা হয়েছিল। কিন্তু প্রকাশনা কর্মীদের স্বচ্ছ ব্যবহার আমাকে আশ্বস্ত করে। বইয়ের খোঁজ নেওয়া থেকে বইটি হাতে পৌঁছনো অবধি আমাকে খুবই সাহায্য করেছেন সবাই। বইটি অর্ডার করার পর দ্রুত আমার হাতে চলে আসে। অত্যন্ত যত্নে পাঠিয়েছেন ওরা। এমনটাই তো হওয়া উচিত। শ্রদ্ধেয় রাজা সরকারের লেখা আমি আগে পড়িনি। মণিকর্ণিকাই আমাকে তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিল। আমি কৃতজ্ঞ। এইবারে মণিকর্ণিকা প্রকাশিত ‘দেশ কাল’ বইটি পড়ব। বন্ধুবান্ধবের কাছে মাঝে মাঝেই বইটির রেকমেন্ডেশন পাচ্ছি।
[আমি ফেসবুকে নেই। প্রকাশনা থেকে অনুরোধ করেছিল বইটি পড়ে যেন যা মনে হয় লিখে দিই। ভালো লাগলে ভালো, মন্দ লাগলে মন্দ। তাই কটি কথা লিখে দিলাম। এটি ওনারা ইচ্ছেমতো শেয়ার করতে পারেন।]
পাঠ-প্রতিক্রিয়া: নৃমুণ্ডের মীমাংসা
জঁর: উপন্যাস
লেখক: রাজা সরকার
প্রকাশক: মণিকর্ণিকা
Comentarios