top of page

কেঁচে গণ্ডুষ । শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায়


নারান মুখুজ্যের একমাত্র ছেলে অমল, আজ সকালে মারা গিয়েছে। চুঁচুড়া হাসপাতালে ভর্তি ছিল। সাতদিন ধরে ধুম জ্বর। হাত ফুলল, পা ফুলল, গায়ের রঙ পুড়ে কালো হয়ে এল। ডাক্তার নার্স কত ছোটাছুটি করল, সকাল বিকেল কতরকমের পরীক্ষা করল, কিন্তু রোগ ধরতে পারল না। নারান চেষ্টার কসুর করেনি। জলের মতো টাকা খরচ করেছে, ডাক্তারবাবুদের হাতে-পায়ে ধরেছে। তবু, ছেলেটাকে এ যাত্রায় আর বাঁচাতে পারল না।

হাসপাতালের বিল মিটিয়ে শববাহী গাড়ি ভাড়া করে ছেলের দেহ নিয়ে সে যখন গ্রামে ফিরল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। সারা গ্রাম ভেঙে পড়ল নারানের বাড়িতে। ছেলের মা জ্ঞান হারাল। অমলের বউয়ের আছাড়ি-পিছারি কান্না দেখে গ্রামের লোকের বুক হুহু করে উঠল। এর মধ্যেই কার যেন খেয়াল হল- পিকলু কোথায় গেল? পিকলু অমলের ছেলে, বয়স বছর তিনেক। এই একটু আগেও তো এখানেই খেলে বেড়াচ্ছিল। সে কোথায় গেল? নারানই বা গেল কোথায়?

(২)


পরপর তিনবারের চেষ্টাতেও নারান যখন ম্যাট্রিকের গণ্ডি পার করতে পারল না, তখন তার বাবা বলল- ‘আর পাস করে কাজ নেই। তোর আর লেখাপড়া হবে না, কাল থেকে মাঠে গিয়ে চাষবাস করিস। বাবার কথা শিরোধার্য করে পরের দিন ভোর থেকেই নারান মাঠে নামল। সেই শুরু।’

তার বাবার বিঘে পাঁচেক জমি ছিল। এক মরসুম খেটেই নারান বুঝল, চাষ-আবাদ জিনিসটা তাকে নেশার মতো পেয়ে বসেছে। পায়ের তলায় ভিজেমাটির নরম স্পর্শ, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে লেগে থাকা সবুজের গন্ধ অথবা পাকা ধানের শীষে হাওয়া লেগে উঠে আসা শিরশিরে শব্দ, এ সবকিছুই যেন তাকে টানে। সে উদয়-অস্ত কঠোর পরিশ্রম করতে লাগল। দিনমজুরির কিষেনদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে বীজ বুনতো, দক্ষ হাতে লাঙলের হাল ধরতো, পাকা ধানের আঁটি মাথায় করে বয়ে এনে খামারে ফেলতো। এ নিয়ে প্রথমদিকে যে গ্রামে কথা ওঠেনি তা নয়।

‘বাবুঘরের ছেলে হয়ে কিষান-মজুরদের সঙ্গে একসঙ্গে মাঠে খাটা, এ আবার কেমন ধারার কথা!’

নারান অবশ্য সে সব কথায় কোনো আমল দেয়নি কোনোদিনই। জমিতে তার অনেক কাজ, এসব ছেঁদো কথায় কান দেওয়ার সময় কোথায়?

বীজ বোনা, ধান রোয়া, ঝাড়াই পেটাই- এসব নিয়েই দিন কাটতে লাগল নারানের। লোকে বলতে লাগল, ‘নারানের হাতে সোনা ফলে’।

তারপর একদিন তার বাপ-মা চোখ বুজল। সংসারের হাল ধরতে ঘরে বউ নিয়ে এল নারান। তবে আর সংসারী হতে পারল না। বউয়ের হাতে ঘরের দায়িত্ব তুলে দিয়ে আরও মন দিয়ে লেগে পড়ল চাষের কাজে। সে বলত- ‘জমি হল মা, আর ফসল হলেন স্বয়ং মা লক্ষ্মী। চাষ করা নয়তো- যেন পুজো করা’।

বামুনের ছেলে হয়ে নাকি চাষ করা যায় না! লোকের কথা শুনে নারানের হাসি পেত। বছর দু-তিন যেতে না যেতে নারানের বউয়ের কোলে ছেলে এল। নারান শখ করে নাম রাখল- অমল। স্কুলে পড়ার সময় সে রবিঠাকুরের ডাকঘর পড়েছিল। এ নামে যেন মাটির গন্ধ লেগে আছে।


(৩)


শিশুকে যে বয়সে বাপ-মা অক্ষর চেনায়, সেই বয়স থেকে অমলকে জমিতে নিয়ে যেতে শুরু করল নারান। ভোর হতেই ছেলেকে কাঁধে বসিয়ে বেরিয়ে পড়তো। খালি পায়ে জলকাদা ভেঙে এ-মাঠ সে-মাঠ ঘুরে বেড়াতো। ছোট্ট অমল বাবার ঘাড়ের দুপাশ দিয়ে ছোট ছোট পা দুটো ঝুলিয়ে মাথাটা শক্ত করে ধরে থাকতো। মাঝেমধ্যে তাকে আলের মাটিতে নামিয়ে রেখে নারান বীজধানের চারার মাথা থেকে শিশির ঝেড়ে দিত, আলের মুখে কাঁকড়ার গর্ত বুজিয়ে জমির জল আটকাতো, আলুর ভুঁই থেকে ঝুড়ি ভর্তি করে তুলে আনতো বেথুয়া শাক। অমল চুপটি করে পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখত, আর মাঝে মাঝে এটা সেটা প্রশ্ন করতো। ছেলের আগ্রহ দেখে নারানও তাকে চাষ-আবাদের নানান খুঁটিনাটি, সহজ কথায় বুঝিয়ে দিত।

নারানের বউ মাঝেমধ্যে বলতো- অতটুকু ছেলে, তাকে কেন মাঠে নিয়ে যাওয়া! জলকাদায় ঠাণ্ডা লাগার কথা না হয় বাদই দিলাম, সাপখোপের ভয়ও তো আছে।’

নারান উত্তর দিত- ওর বাপ চাষ করে খায়, ওর রক্তেও চাষ আছে। এই বয়স থেকে মাঠে না গেলে মাটির উপর টান হবে কেমন করে? বাপের থেকে পাবে বলতে তো এই চাষের নেশাটুকু। তুমি এ নিয়ে আর কিছু বোলো না।’

নারানের বউ আর আপত্তি করেনি।

বাবার মতো অমলেরও লেখাপড়া বেশিদূর গড়ায়নি। মাধ্যমিকের গণ্ডিটুকু কোনোরকমে পেরিয়েই সে পুরোদমে চাষের কাজে লেগে পড়ল। বাবার ছায়ায় পাকা চাষি হয়ে উঠতে তার বেশি দিন লাগল না। বাপ-ছেলের মিলিত পরিশ্রমে সংসারে বেশ সমৃদ্ধি এল। পৈতৃক পাঁচ বিঘে জমি বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় বিঘে বিশেক। বছর খানেক হল অমল একটা ট্রাকটারও কিনেছে। ধান, আলুর পাশাপাশি পুরোদমে শুরু করেছে সব্জির চাষ, ফুলের চাষ, মরসুমি ফলের চাষ।

অমল আর নারান এখন এলাকার বেশ নামকরা চাষি। আশপাশের গ্রাম থেকে লোকে আজকাল তাদের কাছে পরামর্শ নিতে আসে। কোন জমিতে কোন ফসলের চাষ করলে ভালো হয়, ধান-আলুর কোন রোগে কী ওষুধ দিলে ফল পাবে।


(৪)


পিকলু হওয়ার পর থেকে নারানের চাষ-আবাদের নেশাটা একটু হলেও কেটেছে। সে যে মাঠে যায় না তা নয়, তবে নেহাতই প্রয়োজন পড়লে। চাষের দিকটা আজকাল অমলই দেখে। নারান এখন সকাল-বিকাল নাতির হাত ধরে বেড়াতে যায়। সন্ধ্যাবেলা গোয়ালাপাড়া থেকে দুধ নিয়ে আসে। সুর করে সে নাতিকে ছড়া শেখায়। গ্রামের পাঁচজনে জিজ্ঞাসা করলে বলে- ‘ছেলের মতো নাতিও আমার নামকরা চাষি হয়ে উঠবে একদিন।’

তবে অমলের মতো পিকলুকে নিয়ে মাঠে যায় না নারান। সে জানে ছেলের মতোই চাষটা নাতিরও রক্তেই আছে। এখন সে খেলুক, পড়ুক, আনন্দ করুক। যখন প্রয়োজন পড়বে, চাষের কাজটুকু তার বাবাই তাকে শিখিয়ে নেবে।

নিরলস কর্মীর জীবন থেকে আস্তে আস্তে বিদায় নিয়ে নারান যখন অবসরের দিকে পা বাড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই অসময়ের শিলাবৃষ্টির মতো এই নিদারুণ আঘাত নেমে এল তার জীবনে। তছনছ হয়ে গেল তার ফলন্ত সংসার, এলোমেলো হয়ে গেল সব হিসাব নিকাশ।

একদিন মাঠ থেকে ফিরে সোজা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল অমল। গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। হাত-পায়ে প্রবল যন্ত্রণা। সবাই ভাবল, সাধারণ জ্বর- দুদিনেই সেরে যাবে। ঘরোয়া চিকিৎসা চলল। দুদিন পর জ্বর তো কমলই না, বরং বেড়ে চলল সমানে। গ্রামের নীলমাধব ডাক্তারকে ডাকা হল। একদিন পর সেও জবাব দিল। ছেলেকে নিয়ে পাণ্ডুয়া ছুটল নারান। সেখান থেকে চুঁচুড়া। কলকাতাতেও হয়তো নিয়ে যেত, কিন্তু ডাক্তারবাবু দেখে বললেন ছেলের শরীর খুবই দুর্বল। এই মুহূর্তে কলকাতা অবধি টানা-হেঁচড়া সহ্য করতে পারবে না। কাজেই, যা হওয়ার এখানেই হবে।

তারপর চারটে দিন চেষ্টার কোনো কসুর রাখেনি নারান। যত পরীক্ষা করানো যায় করিয়েছে। ডাক্তারবাবুদের কাছে যতবার যেতে হয় ছুটে গিয়েছে, কিন্তু লাভ হয়নি কিছুই। যে যাবে বলে পা বাড়িয়ে ফেলেছে তাকে কি ফেরানো যায়? গতকাল রাত থেকেই আর জ্ঞান ফেরেনি অমলের। আজ সকালে ডাক্তারবাবু নিথর দেহটার সামনে এসে ঘাড় নেড়ে চলে গেলেন।

ছেলের মৃতদেহ নিয়ে নারান যখন বাড়ি ফিরল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। সারা গ্রাম ভেঙে পড়ল নারানের বাড়িতে। ছেলের মা জ্ঞান হারালো। অমলের বউয়ের আছাড়ি-পিছারি কান্না দেখে গ্রামের লোকের বুক হু হু করে উঠল। এর মধ্যেই কার যেন খেয়াল হল- পিকলু কোথায় গেল? এই একটু আগেও তো এখানেই খেলে বেড়াচ্ছিল। সে কোথায় গেল? নারানই বা গেল কোথায়?’


(৫)


এই শোক-সমুদ্র থেকে অনেকদূরে জল-কাদা মাখা আল বেয়ে তখন এগিয়ে চলেছে নারান। তার কাঁধে বসে রয়েছে পিকলু। দাদুর ঘাড়ের পাশ দিয়ে ছোটো ছোটো পা দুটো ঝুলিয়ে তার মাথাটা শক্ত করে ধরে, বসে আছে সে। যেমন করে আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে তার বাবা অমল বসে থাকত। নারান এগিয়ে চলে। সামনে তার অনেক কাজ। নতুন উত্তরাধিকারী তৈরি করতে হবে। নারান মুখুজ্যের আরাধ্যা দেবী- এই মাটি- এ জীবনে তার কপালে বিশ্রাম লেখেননি হয়তো। তার স্বেদবিন্দুতে তৃষ্ণা মেটেনি মাটির৷ অশ্রুবিন্দুতে মিটবে কি?

তখন পশ্চিম আকাশ লালে লাল। নারান আর পিকলুর দীর্ঘ দুটি ছায়া ধীর পদক্ষেপে পুব দিগন্তের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।


ছবি : সর্বজিৎ সরকার

Comentários


1111-removebg-preview.png

গল্পের বই উপহার পেতে কে না চায়!
এখনই Subscribe  করুন,
আর পেয়ে যান আপনার প্রথম বইটির মূদ্রিত মূল্যের ওপর ২৫% ছাড় 

Thanks for being our family!

  • Youtube
  • pngwing.com
  • 1111
  • tumblr
  • Instagram LOGO PNG2

+91 8240333741

Magic Seeds Books LLP

119 Abhay Patuli Lane, Shuksanatantala, Chandannagar 712136

Email us at: manikarnika.pub@gmail.com

For any other queries feel free to reach us at: 8240333741(Call/Whatsapp)

©2022 by Manikarnika Prakashani.

bottom of page